পিরোজপুরে ১৩ বছরে ১০১ কোটি টাকা পাচার: ৭ ব্যক্তি ও ২ প্রতিষ্ঠানের নামে মামলা

পিরোজপুরে ১৩ বছরে ১০১ কোটি টাকা পাচার: ৭ ব্যক্তি ও ২ প্রতিষ্ঠানের নামে মামলা

দেশজুড়ে স্লাইড

দীর্ঘ তদন্তের পর অবশেষে পিরোজপুরের একটি সুপরিকল্পিত আর্থিক প্রতারণা কেলেঙ্কারির বিস্তারিত চিত্র ও অভিযোগ আদালতে জমা দিয়েছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ২০০৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত টানা ১৩ বছর ধরে ‘এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’ ও ‘এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমিটেড’ নামে দুই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে স্থানীয়, প্রবাসী ও প্রতিষ্ঠান থেকে ১০১ কোটি ৪৫ লাখ ৯৪ হাজার ২৩৮ টাকা সংগ্রহ এবং তা পাচারের অভিযোগে ৭ ব্যক্তি ও ২ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসীম উদ্দিন খান বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, পিরোজপুর সদর থানায় দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত শেষে প্রমাণাদির ভিত্তিতে এই অভিযোগপত্র প্রস্তুত করা হয়েছে।

প্রতারণার কৌশল: বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুনাফার প্রলোভন

সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, রাগীব আহসান (৪০) ও তার স্ত্রী সালমা আহসান (৩২) কেন্দ্রীয় ভূমিকায় থেকে এই অপকর্মের নেতৃত্ব দেন। তারা তাদের প্রতিষ্ঠান দুটিকে সম্পূর্ণ বৈধ ও লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে উপস্থাপন করে। পিরোজপুর, বরিশাল ও আশেপাশের এলাকার মানুষদের লক্ষ্য করে তারা সরাসরি বাড়ি-বাড়ি গিয়ে, স্থানীয় সভা-সমাবেশে অংশ নিয়ে এবং এজেন্ট নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিনিয়োগ আহ্বান করতেন। সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী এবং প্রবাসীদের পরিবার ছাড়াও স্থানীয় মসজিদ, স্কুল ও মাদ্রাসার তহবিল থেকেও তারা টাকা সংগ্রহ করেছে বলে প্রমাণ মিলেছে।

ভুক্তভোগী এক হাজারেরও বেশি

প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এই চক্রের জালে পড়ে বিনিয়োগ করেছেন এক হাজারেরও বেশি মানুষ। অনেকেই তাদের জীবনসঞ্চয়, জমিজমা বিক্রয়ের অর্থ, এমনকি বিদেশ থেকে প্রেরিত রেমিট্যান্সও এই প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে তুলে দিয়েছিলেন প্রতিশ্রুত উচ্চ মুনাফার আশায়।

টাকা পাচার ও আত্মসাতের চিত্র

সিআইডি তদন্তে উঠে এসেছে, সংগৃহীত এই বিপুল অর্থ পরস্পরের যোগসাজশে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রয়সহ ব্যক্তিগত বিভিন্ন খাতে ব্যবহারের মাধ্যমে আত্মসাৎ ও পাচার করা হয়েছে। অর্থ পাচারের এই কার্যক্রমে রাগীব আহসান দম্পতির পাশাপাশি অভিযুক্ত হিসাবে আছেন তাদের নিকট আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা। তারা হলেন: মো. আবুল বাশার খান (৩৫), খায়রুল ইসলাম (৩৫), শামীম হাসান (৩৭), মো. মাহমুদুল হাসান (৩১) ও মো. নাজমুল ইসলাম। এরা সকলেই প্রতিষ্ঠান দুইটির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকে অর্থ সংগ্রহ ও স্থানান্তরে সরাসরি জড়িত ছিলেন।

ভুক্তভোগীদের আইনি লড়াই ও সিআইডির তদন্ত

এই প্রতারণার শিকার হয়ে ইতোপূর্বে পিরোজপুর সদর থানাসহ বিভিন্ন থানায় ভুক্তভোগীরা প্রায় একশ’র মতো মামলা দায়ের করেছিলেন। সিআইডি এসব মামলা যাচাই-বাছাই ও গভীর অনুসন্ধানের পর এই কেলেঙ্কারির বিস্তৃত চিত্র উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয় এবং নিজস্ব একটি মামলা দায়ের করে ব্যাপক তদন্ত কার্যক্রম চালায়।

অভিযুক্তরা হাজতে

দীর্ঘ তদন্তকাল শেষে সিআইডি আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করায় এখন আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে। অভিযুক্ত সাত ব্যক্তি বর্তমানে হাজতে আছেন এবং প্রতিষ্ঠান দুইটির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার জসীম উদ্দিন খান আরও জানান, অর্থ পাচারের এই জটিল নেটওয়ার্ক উন্মোচনে সিআইডি কঠোর পরিশ্রম করেছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, দ্রুত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়ে ভুক্তভোগীদের কিছুটা সান্ত্বনা দেবে এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের আর্থিক প্রতারণা রোধে একটি শক্তিশালী বার্তা যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *