টানাপোড়েনে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক

জাতীয় স্পেশাল

 

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কূটনৈতিক টানাপোড়েনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে, যা দিনকে দিন জটিল থেকে জটিলতর রূপ নিচ্ছে। এই উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবার “কাজের সম্পর্ক” বজায় রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করা হলেও দু’দেশের সম্পর্ক যে কাঙ্ক্ষিত গতিতে এগোতে পারেনি, সে কথা স্বীকার করেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। গতকাল বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি এই মন্তব্যের পাশাপাশি ভারতের সাম্প্রতিক আচরণ ও বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানান।

পরস্পর তলব ও সম্পর্কের উত্তাপ

গত কয়েক দিনের ঘটনাপ্রবাহ দুই দেশের মধ্যকার উত্তাপকে স্পষ্ট করে দিয়েছে। গত রোববার ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলব করে বাংলাদেশ সরকার। এর পাল্টা হিসেবে গতকাল বুধবার সকালে নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার এম রিয়াজ হামিদুল্লাহকে তলব করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ভারতীয় দূতাবাসের উদ্দেশে জুলাই ঐক্যের কর্মসূচি এবং সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতবিরোধী বলে দাবিকৃত কিছু মন্তব্যের প্রতিবাদে এই তলব করা হয়েছে।

ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের বিবৃতিতে বলেছে, তারা বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিবেশের অবনতিতে “তীব্র উদ্বেগ” প্রকাশ করছে এবং দাবি করেছে যে, চরমপন্থী উপাদানগুলো সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়ে “মিথ্যা বর্ণনা” তৈরি করছে। ভারতের অভিযোগ, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ঘটনাগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করেনি বা ভারতের সঙ্গে প্রমাণ ভাগাভাগি করেনি।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টার কঠোর প্রতিক্রিয়া

এই প্রেক্ষাপটে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন তাঁর বক্তব্যে বেশ কয়েকটি ইস্যুতে ভারতের সমালোচনা করেন এবং বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট করেন:

১. “নসিহত” প্রত্যাখ্যান: উপদেষ্টা ভারতের সাম্প্রতিক বক্তব্যের প্রতি তীব্র আপত্তি জানিয়ে বলেন, “বাংলাদেশে নির্বাচন কেমন হবে এটা নিয়ে আমরা প্রতিবেশীদের উপদেশ চাই না।” তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই সরকার প্রথম দিন থেকেই একটি উচ্চমানের নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে, যা গত ১৫ বছর ছিল না। তিনি মন্তব্য করেন, “ওই সময় নির্বাচনগুলো যে প্রহসনমূলক হয়েছিল, সে সময় তারা (ভারত) একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। এখন আমরা একটা ভালো নির্বাচনের দিকে যাচ্ছি, এই মুহূর্তে আমাদের নসিহত করার তো প্রয়োজন নেই।”

২. শেখ হাসিনা ইস্যু: উপদেষ্টা ভারতের আশ্রয়ে থাকা বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্রমাগত “উস্কানিমূলক” বক্তব্যের প্রতি কঠোর ভাষায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, “শেখ হাসিনা আদালত থেকে শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছেন। তিনি আমাদের পাশের দেশে বসে, এখানে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন।” তিনি ভারতের কাছে দাবি জানান, হাসিনাকে থামানো হোক এবং প্রয়োজনে ফেরত পাঠানো হোক। তিনি স্বীকার করেন, “ভারত যদি তাঁকে থামাতে না চায়, আমরা থামাতে পারব না।”

৩. মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রসঙ্গ: বাংলাদেশের বিজয় দিবসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বার্তা এবং কলকাতায় ‘ইস্টার্ন কমান্ড দিবস’ পালনের প্রসঙ্গ টেনে উপদেষ্টা বলেন, “ভারত সব সময় মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশিদের ভূমিকাকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করে।… মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা ছাড়া ভারত এই বিজয় অর্জন করতে পারত না।” এটি দু’দেশের মধ্যে ইতিহাসের ব্যাখ্যা নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী একটি সংবেদনশীল ইস্যুকে আবারও সামনে নিয়ে আসে।

৪. সম্পর্কের ভবিষ্যৎ: টানাপোড়েন কাটিয়ে সম্পর্ক এগোবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, “আমরা চাইলে সেটা হবেই– এমন তো কথা নেই। সম্পর্ক দুপক্ষ থেকেই এগোনোর চেষ্টা করতে হবে। আমার মনে হয় আমরা দুপক্ষ মিলে হয়তো অতটা এগোতে পারিনি, যে কারণে টানাপোড়েনটা রয়েই গেছে।”

মাঠ পর্যায়ের ঘটনা: মিছিল, নিরাপত্তা ও বাণী

ঢাকায় গতকাল জুলাই ঐক্যের ডাকে ভারতীয় হাইকমিশনের দিকে একটি মিছিলের আয়োজন করা হয়। পুলিশ উত্তর বাড্ডায় এ মিছিল আটকে দেয় এবং নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা ভারতের প্রতি বেশ কিছু অভিযোগ তোলেন, যার মধ্যে জুলাই মাসের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের ভারতে আশ্রয় দেওয়া এবং শেখ হাসিনাসহ সাজাপ্রাপ্তদের ফেরত চাওয়া উল্লেখযোগ্য। তারা হুঁশিয়ারি দেয় যে তাদের দাবি না মানা হলে ভারতীয় হাইকমিশনে ঢুকে পড়া হতে পারে।

এছাড়াও, ভারতীয় ভিসা সেন্টার অস্থায়ীভাবে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে উপদেষ্টা বলেন, এটি নিরাপত্তাজনিত সিদ্ধান্ত হতে পারে এবং ভিসা সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো দেশই তার সার্বভৌম সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

আঞ্চলিক রাজনীতির প্রতিধ্বনি

এই টানাপোড়েন শুধু দ্বিপাক্ষিক নয়, আঞ্চলিক রাজনীতির ছোঁয়াও লেগেছে। বাংলাদেশের জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা হাসনাত আবদুল্লাহর ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল নিয়ে মন্তব্যের প্রত্যুত্তরে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা কঠোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, “ভারতের সঙ্গে এমন ব্যবহার করলে আমরা চুপ করে বসে থাকব না।” এটি দেখায় যে, ঢাকা-দিল্লির দ্বিপাক্ষিক উত্তাপ পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোর রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক বর্তমানে একটি স্পর্শকাতর ক্রসরোডে দাঁড়িয়ে। দীর্ঘদিনের মিত্রতা ও সহযোগিতার সম্পর্ক এখন পারস্পরিক অবিশ্বাস, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রক্ষেপণ এবং কূটনৈতিক ধাক্কাধাক্কির মুখোমুখি। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, বিশেষ করে আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে ভারতের অবস্থান এবং ভারতে বসবাসরত বাংলাদেশি বিরোধী নেতাদের কার্যকলাপ এই টানাপোড়েনের মূল অক্ষ তৈরি করেছে। বাংলাদেশ সরকার প্রকাশ্যে ভারতের “উপদেশ” প্রত্যাখ্যান এবং “সার্বভৌমত্ব” জোরদারের ভাষ্য ব্যবহার করছে। অন্যদিকে, ভারত তার দূতাবাসের নিরাপত্তা ও “অবাধ্য” প্রতিবেশীর আচরণ নিয়েও চিন্তিত। এই জটিল পরিস্থিতিতে উভয় পক্ষের জন্য কূটনৈতিক দক্ষতা, সংলাপ এবং পরস্পরের উদ্বেগের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোই হবে উত্তেজনা প্রশমনের একমাত্র উপায়। সামনের দিনগুলোতে এই সম্পর্ক কোন দিকে মোড় নেয়, তা নির্ভর করবে উভয় রাজধানীর সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ডের ওপর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *