শেষ মুহূর্তের হিসাব-নিকাশে রাজনৈতিক দলগুলো

শেষ মুহূর্তের হিসাব-নিকাশে রাজনৈতিক দলগুলো

রাজনীতি বিশেষ প্রতিবেদন

 

আগামী ১২ ফেব্রুয়ারির ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক মাঠ এখন তীব্র হিসাব-নিকাশ, কূটকৌশল আর জোটজটের এক জটিল অঙ্কে আবদ্ধ। আনুষ্ঠানিক মনোনয়ন বিক্রি শুরু হলেও ৩০০ আসনে চূড়ান্ত প্রার্থী নির্ধারণ করতে গিয়ে বিএনপি, জামায়াতসহ বেশিরভাগ দলই হিমশিম খাচ্ছে। দীর্ঘ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর জন্য আসন ছাড় দিতে গিয়ে বিএনপির ঘরে তৈরি হয়েছে গণ-অসন্তোষ ও উত্তাপ। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতির সুযোগে ‘বিকল্প শক্তি’ হিসেবে আবির্ভূত হতে চাইলেও জামায়াত-নেতৃত্বাধীন জোটও আটকে আছে ‘ওয়ান বক্স পলিসি’র জটিল বাস্তবায়নে। ফলস্বরূপ, বিরোধী রাজনীতির পুরো অঙ্গন এখন আসন বণ্টনের গলাটেপা ধরা সমীকরণ, ক্ষোভ আর অভিমানের এক জটিল লড়াইয়ে পর্যবসিত।

বিএনপির গলার কাঁটা: মিত্রদের চাপ ও অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ

বিএনপি ইতিমধ্যেই ২৭২টি আসনে নিজস্ব সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করলেও বাকি ২৮টি আসনের জন্য মিত্র দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছানো তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলটির ‘একলা চলো’ নীতি ও বাকি আসনগুলোতে অনমনীয় মনোভাব মিত্র দলগুলোতে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।

বেইমানির অভিযোগ: লেবার পার্টি ইতিমধ্যেই বিএনপির সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়েছে। দলীয় চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান সরাসরি ‘বেইমানি’র অভিযোগ তোলেন।

আলটিমেটাম: বিএনপির মিত্র ২৯টি দল গত সপ্তাহে বৈঠক করে আসন বণ্টনের সন্তোষজনক সমাধান না হলে আলাদা নির্বাচনি জোট গঠন এবং বিএনপিকে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

অস্বস্তিকর বৈঠক: বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সঙ্গে বিএনপির একটি বৈঠক অস্বস্তিকর পরিবেশে শেষ হয়, যেখানে দলের শীর্ষ নেতা সাইফুল হক ক্ষুব্ধ হয়ে বৈঠকস্থল ত্যাগ করেন।

অভ্যন্তরীণ অশান্তি: শুধু মিত্র দলই নয়, বিএনপির নিজস্ব ঘোষিত ২৭২ আসনের মধ্যে অন্তত ৫০টি আসনে স্থানীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে প্রার্থী নির্ধারণ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ ও বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে তারা সক্রিয়।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, “যাদের সঙ্গে আমরা আন্দোলন করেছি, তাদের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত আছে। আমরা আশা করি-সমাধান বের হবে।” তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. শান্তনু মজুমদার মন্তব্য করেন, “বিএনপি একটি কৌশলগত দোলাচলে আছে। তারা একদিকে শক্তিশালী মিত্র চায়, অন্যদিকে দুর্বল মিত্রদের বেশি আসন দিতে নারাজ। এই দ্বিধা তাদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, কারণ নির্বাচন শুধু আসনের গাণিতিক সমীকরণ নয়, রাজনৈতিক বিশ্বাস ও জোটনীতিরও পরীক্ষা।”

জামায়াতের ‘ওয়ান বক্স’ স্বপ্ন ও বাস্তবতার টানাপোড়েন

জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনসহ আট দলের জোট ‘বিকল্প শক্তি’ হিসেবে আবির্ভূত হতে চাইলেও তাদের ‘ওয়ান বক্স পলিসি’ (প্রতি আসনে একজন প্রার্থী) এখনো কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। জামায়াতকে বেশি আসন দিতে অনিচ্ছুক ছোট দলগুলোর কারণে একাধিক বৈঠক সত্ত্বেও আসন বণ্টনের চূড়ান্ত সমঝোতা হয়নি। শরিক দলের এক নেতার ভাষ্যে, “সবাই যদি ছাড় দিতে রাজি হতো, এই জট অনেক আগেই কাটত।” নির্বাচনী মনোবিজ্ঞানী ড. নাসরীন আহমেদ মনে করেন, “‘ওয়ান বক্স’ নীতির সাফল্য নির্ভর করবে শরিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা ও ত্যাগের মাত্রার ওপর। যদি বড় দল সব শক্তিধর আসন দখল করে, তাহলে ছোট দলগুলো ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারাবে, ফলে জোটের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে।”

নতুন জোটের সম্ভাবনা ও অনিশ্চয়তা

বিএনপি ও জামায়াতকেন্দ্রিক জোটের বাইরেও বেশ কয়েকটি নতুন জোট গঠনের প্রক্রিয়া চলছে, তবে সেখানেও চূড়ান্ততা নেই।

গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট: এনসিপি, এবি পার্টি ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ে গঠিত এই জোটে এনসিপি ১২৫ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করলেও চূড়ান্ত আসন বণ্টন এখনো অনিশ্চিত।

জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এনডিএফ): জাতীয় পার্টির একটি অংশ নেতৃত্ব দিচ্ছে ১৮ দলের এই জোটটি।

গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট: নয়টি বাম দলের এই জোট আন্দোলন ও নির্বাচনে একসঙ্গে কাজের ঘোষণা দিলেও তারা শেষ পর্যন্ত স্বতন্ত্র থাকবে নাকি বড় কোনো জোটে যুক্ত হবে, সে সিদ্ধান্ত এখনো স্পষ্ট নয়।

বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়ন: সময় কম, জট বাড়ছে

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাসুদা মোশাররফ মনে করেন, “নির্বাচনের সময়সীমা যখন সন্নিকটে, তখন দলগুলোর মধ্যে এই দীর্ঘসূত্রতা ও অভ্যন্তরীণ কোন্দল বিরোধী রাজনীতির জন্য অশনিসংকেত। ভোটারদের কাছে জোট বা দলগুলোর একটি সুনির্দিষ্ট ও ঐক্যবদ্ধ বার্তা পৌঁছানোর জন্য সময় খুবই কম। এই বিশৃঙ্খলা শেষ পর্যন্ত ভোটারদের মনোজগতে বিভ্রান্তি ও হতাশা তৈরি করতে পারে।”

তিনি আরও যোগ করেন, “আসন বণ্টন কেবল সংখ্যার খেলা নয়; এটি স্থানীয় জনপ্রিয়তা, প্রার্থীর সামর্থ্য এবং দলীয় সংগঠনের শক্তির ওপরও নির্ভরশীল। যে দলগুলো শেষ মুহূর্তে শুধু চাপা অসন্তোষ ঢেকে রেখে আসন বণ্টন করবে, নির্বাচনের দিন তাদের জন্য বড় ধরনের অপ্রীতিকর বিস্ময় অপেক্ষা করতে পারে।”

শেষ মুহূর্তের চাপ

মনোনয়নপত্র জমাদানের শেষ তারিখ ২৯ ডিসেম্বর। এরমধ্যে দলগুলোকে তাদের অভ্যন্তরীণ ও জোটগত সকল জটিলতা সমাধান করতে হবে। সময়ের এই চাপে হয়তো কয়েকটি দল জোট ছাড়বে, হয়তো নতুন জোট গঠিত হবে। তবে এটা স্পষ্ট, আসন্ন নির্বাচনটি শুধু সরকার গঠনের প্রতিযোগিতা নয়, এটি বিরোধী শিবিরের নেতৃত্ব, সংগঠনক্ষমতা এবং ঐক্যবদ্ধ থাকার সক্ষমতারও এক চূড়ান্ত পরীক্ষা হবে। এই পরীক্ষায় কার নম্বরা কত হয়, সেটিই এখন সবচেয়ে বড় অপেক্ষার বিষয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *