মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের প্রথম আত্মসমর্পণের নায়ক জামালপুরের বশির আহমেদ

৬৩২

লেখক : মোঃ মেহেদী হাসান: উত্তরে ভারতের মেঘালয়, পূর্বে পাহাড় ঘেরা ও পর্শ্চিমে নদি আর চরাট অঞ্চল নিয়ে জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী ধানুয়া কামালপুর ইউনিয়ন। ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা গ্রাম লাউচাপড়ায় বাড়ি বীর মুক্তিযোদ্ধা বশির আহমেদের (বীর প্রতিক)।

১৯৭১, হঠাৎ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো, সেই ছোট্ট ‘বসির’ তখন ধানুয়া কামালপুর কো-অপারেটিভ উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর মেধাবী ছাত্র। কতই বা, হবে তার বয়স ১৫ কিংবা ১৬। কিন্তু এতো অল্প বয়সেই, তাঁর মনের গভীরতা ছিল সমুদ্রের চেয়েও অতল।

সেই ছূট্ট খুকা এ কি দেখছে..!! চোঁখের সামনে পাক সেনারা তাঁর দেশের মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করছে, নারীদেরকে করছে ধর্ষণ, আর গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে চালাচ্ছে ধ্বংসযজ্ঞ চলছে, এ যেন এক বিভীশিখাময় দুঃস্বপ্ন। তাই সহ্য হয়নি তাঁর। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, যে কোন মূল্য দেশকে জালেমদের হাত থেকে মুক্ত করতে হবে।

এপ্রিল, ১৯৭১ঃ যুদ্ধের জন্য যখন পরিচিত আরো অনেকেই সীমান্তের ওপারের মহেন্দ্রগঞ্জে গিয়ে ভর্তি হচ্ছিলেন সেই দলে সামিল হলেন তিনিও। কিন্তু বাড়ি থেকে অনুমতি পাননি তিনি তাই বাড়ি এক ভাগনেকে সাথে নিয়ে তিনি পালিয়ে পাড়ি জমালেন মহেন্দ্রগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। তাঁর দু’চোখ জুড়ে তখন একটাই স্বপ্ন যুদ্ধ করে দেশ থেকে তাড়াবেন অত্যাচারী জালেমদের।কিন্তু তার ভাগ্য যেন সাই দিল না প্রথম দফাতেই সফলতার দেখা পাননি বশির অনেক ছুট বলে। মহেন্দ্রগঞ্জে নতুন সদস্য বাছাইয়ের প্রাথমিক কাজটি করছিলেন তাঁরই এক শিক্ষক, সোলায়মান হক। বশিরকে দেখামাত্র তিনি মাথা নাড়তে নাড়তে বলেছিলেন, “তুই তো অনেক ছোট মানুষ। অস্ত্র নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে পারবি না। চলে যা।”

শিক্ষক দের খুব সন্মান করতেন তিনি। শিক্ষকের কথার উপর কি আর কথা চলে! তাই ব্যর্থ মনোরথে ফিরেই আসতে হয়েছিল সেই চ্ছুট বশিরকে। কিন্তু তার মনে যে অদম্য তাড়না ছিল দেশকে শত্রুমুক্ত করার, সেটিকে সঙ্গোপনে লালন করে চলেছিলেন। তাই বাড়ি ফিরে আর যান নি, প্রায় ১৫ দিন মহেন্দ্রগঞ্জেই এক আত্মীয়ের বাসায় কাটিয়ে দিয়েছিলেন।

মে, ১৯৭১ঃ যুদ্ধের জন্য নতুন সদস্য নেয়া হচ্ছে শুনেই লাফিয়ে উঠেছিলেন। ফের চলে গিলেন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। সোলায়মান হক আবারও একই কথাই বললেন। কিন্তু এবার বশির ছিলেন যুদ্ধ করতে বদ্ধপরিকর। তাই তিনি সাহস করে বলেই ফেললেন, “আমি মরা বাঁচা নিয়ে চিন্তা করি না, স্যার। আমি যুদ্ধে যাবই।” সেই ছুট্ট বসিরের মুখে এমন তেজোদ্দীপ্ত কথা ও সেই কথার মাঝে লুকিয়ে থাকা দাবানল নাড়া দিয়েছিল সোলায়মান হককে। আর ‘না’ করেননি তিনি। ভর্তি করে নিয়েছিলেন বশিরকে।

যে অবিচল মনোভাব আর শত্রু মুক্ত করার যে দাবানল দেখিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিলেন, পরবর্তীতেও আর কখনো সেটিকে ফিকে হতে দেননি বসির। ১১ নং সেক্টরে হেলাল কোম্পানির অধীনে যুদ্ধ করেছিলেন। পরবর্তীতে নিযুক্ত হয়েছিলেন মিত্রবাহিনীর একটি কোম্পানিতেও। রেকি করা ও দোভাষীর দায়িত্ব পালন ছাড়াও অংশ নিয়েছিলেন বেশ কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধেও। তবে এমন যুদ্ধ তো করেছিলেন আরো অনেকেই। একটি বিরল কৃতিত্বের কারণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সবার থেকে আলাদা। সেই কৃতিত্বের কারণেই ইতিহাস কখনো তাঁর কথা ভুলবে না। স্বাধীনতার ৫০ বছেরেও তাকে মনে রেখেছে বাংলার ইতিহাস, চিরদিন শ্রদ্ধা ভরে মনে রাখবে। মৃত্যু হাতে বিজয়ের বার্তা এনেছিলেন বশির আহমেদ।

সীমান্তবর্তী কামালপুর পরিচিত ছিল সেক্টর ১১ এর আওতাধীন উত্তরাঞ্চলীয় সেক্টর হতে ঢাকার প্রবেশদ্বার হিসেবে। ফলে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী উভয়ের কাছেই এই সীমান্তচৌকি ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ এক কৌশলগত রণাঙ্গন। হানাদার বাহিনী এই কামালপুরে গড়ে তুলেছিল তাদের এক দুর্ভেদ্য ঘাঁটি। মুক্তিবাহিনীর মূল লক্ষ্য ছিল সেই ঘাঁটি দখল করে গোটা অঞ্চলকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনা। তাই বারবার এখানে যুদ্ধ চলেছিল মুক্তিবাহিনী ও পাক বাহিনীর মাঝে।

নভেম্বর, ১৯৭১ঃ যুদ্ধ চলছে, যতই যুদ্ধ হতে থাকে, কামালপুরে পাক বাহিনী ততই দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে শুরু করে। আর নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে মরণকামড় দেয় মুক্তিবাহিনী। মুক্তিযুদ্ধারা ২৪ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা ১১ দিন অবরুদ্ধ করে রাখে কামালপুর। এই ক’দিনে কোনো দিক থেকেই সাহায্য-সরবরাহের কোন সুযোগ পেতে দেন নি হানাদারদের। বারবার অবরোধ ভাঙার চেষ্টা করে হাঁপিয়ে যায় তারা। মুক্তিবাহিনী ক্রমশ শুষে নিতে থাকে তাদের সবটুকু প্রাণরস। এরপর বাকি ছিল শুধু একটি জিনিসেরই, তা হলো পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ। কিন্তু সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে, সেই আত্মসমর্পণটাই করতে চাইছিল না পাকিস্তানিরা হানাদাররা।

৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ঃ এদিকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়ে যায় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। সেদিন শত শত ভারতীয় যান এসে উপস্থিত হতে থাকে সীমান্তে।
৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ঃ সীমান্তঘেঁষা ভারতীয় গ্রাম ব্রাহ্মণপাড়ায় সশরীরে হাজির হয়েছিলেন ভারতীয় ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেডের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লেয়ারও। এরপর মিত্র ও মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, কামালপুরের পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণ করাতে হবে এবং সেটা যে কোন মূল্যে।কিন্তু, পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ করাতে হলে তো আগে তাদের কাছে চিঠি পাঠাতে হবে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানোর জন্য। চিঠিটি পাঠাতে হবে পাকিস্তানিদের কামালপুর ক্যাম্পের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন আহসান মালিক বরাবর।

সেখানে লেখা থাকবে: “নির্ধারিত সময়ে আত্মসমর্পণ না করলে একযোগে আক্রমণ চলবে, এমনকি বিমান থেকে আঘাত করা হবে।” কামালপুর বিওপি ছিল মুক্তিযুদ্ধের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি রণক্ষেত্র। চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত না হয় চূড়ান্ত হলো।
গুরুত্বপূর্ণ কাজই তো বাকি..!! “পাকিস্তানি ক্যাম্পে কে যাবে আত্মসমর্পণের চিঠি নিয়ে?”
(চোঁখ রাখুন আগামি পর্বে- সাহসী কন্ঠের পাতায়)

100% LikesVS
0% Dislikes
Leave A Reply

Your email address will not be published.