কনস্টান্টিনোপল’ একটি স্বপ্ন শহর

৩৬

লেখক: লতিফ গাজী,ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়: চারটি সাম্রাজ্যের রাজধানী বর্তমানের ইস্তাম্বুল শহরটি ১২ শতকে ইউরোপের সর্ববৃহৎ ও সর্বাপেক্ষা ধনী শহর ছিল। মেগারদের এক গোত্রপ্রধান বাইজাস এর নামে বাইজান্টিয়াম শহরটি স্থাপিত হয়। দীর্ঘকাল ধরে এই শহরের মূল গুরুত্ব ছিল বাণিজ্যবন্দর হিসেবে। কন্সটান্টাইন যখন রোমান সাম্রাজ্যের নতুন রাজধানীর জন্য জায়গা অনুসন্ধান করছিলেন তখন অন্যান্য শহরের কথাও চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু অনেকটা হঠাৎ করেই তিনি এখানে রাজধানী স্থাপন করেন। সেই সাথে তিনি অদ্ভুত ভাবে উন্নতি ঘটান । ভূমধ্যসাগর ও কৃষ্ণসাগরের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী বসফরাস প্রণালীর তীরে অবস্থিত হওয়ায় এবং এই শহরের গুরুত্ব বুঝতে পেরে তৎকালীন সম্রাট কন্সটান্টাইন মূলত এখানে রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী সরিয়ে আনেন এবং তখন এই শহরের নামকরন করেন কনস্টান্টিনোপল যার অর্থ কন্সটান্টাইনের শহর।

শহরটি বেশ কয়েকবার অবরোধের সম্মুখীন হলেও সর্বশেষ ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে চতুর্থ ক্রুসেডের সময় এটি বাইজেন্টাইনদের হাতছাড়া হয়ে পড়ে এবং ক্রুসেডাররা কনস্টান্টিনোপলকে ঘিরে একটি অস্থায়ী ল্যাটিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীতে ফাতিহ সুলতান মুহাম্মদ কন্স্টান্টিনোপল জয় করে, এর নাম পরিবর্তন করে রাখেন “ইস্তাম্বুল” (মতান্তরের “ইসলামবুল”, অর্থাৎ ইসলামের শহর) এ নামটিই এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে।

মুহাম্মাদ ফাতিহ অর্থাৎ বিজয়ী মুহাম্মাদ নামে পরিচিত দ্বিতীয় মুহাম্মাদ ছিলেন ৭ম উসমানীয় সুলতান। অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ১১ বছর বয়সে তাকে প্রথা অনুযায়ী আমাসিয়া শাসনের জন্য প্রেরণ করা হয়। তার পড়াশোনার জন্য সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ কয়েকজন শিক্ষক নিযুক্ত করেন। ইসলামি শিক্ষা তার মনে গভীর প্রভাব ফেলে। বিভিন্ন সময়ে তিনি তার উপস্থিতিতে আলেমদেরকে বিভিন্ন ধর্মীয় বিষয়ে আলোচনার জন্য আহ্বান করতেন। তার শাসনামলে গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে উসমানীয়রা প্রভূত উন্নতি লাভ করে। তিনি নিজেও তুর্কি, আরবি, ফার্সি, গ্রীক ও ইতালীয় ভাষায় পারদর্শী ছিলেন ।

আনাতোলিয়ার কারামানিদের সাথে শান্তি স্থাপনের পর ১৪৪৪ সালের আগস্টে সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ মসনদ ত্যাগ করেন এবং দ্বিতীয় মুহাম্মদ মাত্র ১২ বছর বয়সে সুলতান হন। পোপের প্রতিনিধি কার্ডিনাল জুলিয়ান সিসারিনির মদদে তৎকালীন হাঙ্গেরির রাজা মুসলিমদের সাথে চুক্তি ভঙ্গ করেন। এবং জুলিয়ান তাকে বোঝাতে সক্ষম হন যে মুসলিমদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করলে তা বিশ্বাসঘাতকতা হবে না। হাঙ্গেরির জানোস হুনয়াডির নেতৃত্বে পরিচালিত ক্রুসেডকে মুহাম্মদ প্রতিহত করতে সক্ষম হন। এ সময় সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ তার পিতা মুরাদকে পুনরায় মসনদে বসার অনুরোধ করেন কিন্তু মুরাদ তাতে অস্বীকৃতি জানান। মুহাম্মদ এর ফলে ক্রুদ্ধ হন এবং পিতার কাছে পাঠানো চিঠিতে লেখেন, “যদি আপনি সুলতান হন, তবে এগিয়ে এসে সেনাদের নেতৃত্ব দিন। যদি আমি সুলতান হই তবে আমি নির্দেশ দিচ্ছি আপনি আমার সেনাদের নেতৃত্ব দিন।” এরপর মুরাদ দায়িত্বগ্রহণ করেন এবং ১৪৪৪ সালে ভার্নার যুদ্ধে জয়লাভ করেন।

দ্বিতীয় মুহাম্মদ ১৪৪৪ থেকে ১৪৪৬ সাল পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য সুলতান ছিলেন। কিন্তু ইয়ানিসারিদের একটি বিদ্রোহের কারণে দ্বিতীয় মুরাদ পুনরায় ক্ষমতা গ্রহণ করতে করেন। তিনি ১৪৪৮ সালে কসোভোর দ্বিতীয় যুদ্ধে খ্রিষ্টান জোট বাহিনীকে পরাজিত করেন এবং ১৪৫০ সালে আলবেনিয়ায় অভিযান পরিচালনা করেন। স্কান্ডেরবেগের নেতৃত্বাধীন প্রতিরোধ দমনের জন্য তিনি ক্রুজ দুর্গ অবরোধ করেন। কিন্তু তিনি এতে সফল হননি। ১৪৫০-১৪৫১ সালের শীতকালে মুরাদ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এদির্নে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তার পুত্র দ্বিতীয় মুহাম্মদ সিংহাসনে ১৪৫১ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুনরায় মসনদে বসেন এবং ১৪৮১ সালের মে পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। প্রথম কনস্টান্টিনোপল যুদ্ধের সময় তিনি ও তার শায়খ আকশামসউদ্দিন কনস্টান্টিনোপল এর কাছে সাহাবী আবু আইয়ুব আনসারি এর কবর খুঁজে পান ও পরবর্তীতে সেখানে মসজিদ নির্মাণ করেন। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) ভবিষ্যৎ বাণী কনস্টান্টিনোপল বিজয়টি তখন এই উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ মাত্র ২১ বছর বয়সে কনস্টান্টিনোপল জয় এর মাধ্যমে বিজিত হয়। অবশ্য আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) কনস্টান্টিনোপল বিজয় সম্পর্কে ভবিষ্যতবাণী করে বলেন: “অবশ্যই তোমাদের(মুসলিমদের) হাতে একদিন কনস্টান্টিনোপল বিজিত হবে। বিজয়ী বাহিনির আমির কতই না উত্তম আমির! আর বিজয়ী দলটিও কতই না শ্রেষ্ঠ।”
তিনি অসামান্য দক্ষতার জন্য তৎকালীন সময়ে সবচেয়ে বড় কামান ও স্থল ভাগের উপর দিয়ে জাহাজ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল । কনস্টান্টিনোপল যুদ্ধের অন্যতম কৃতিত্ব হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং এর ফলে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের (বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য) পতন হয়।
আধুনিক তুরস্ক ও মুসলিম বিশ্বে সুলতান মুহাম্মদ একজন বীর হিসেবে সম্মানিত হন। কেননা তিনি একাধারে আনাতোলিয়া, আলবেনিয়া, বসনিয়া, ক্রিমিয়া, ইতালি পর্যন্ত ইউরোপ অভিযান অব্যাহত রাখেন। তার স্মরণে ইস্তানবুলের ফাতিহ জেলা, ফাতিহ সুলতান মুহাম্মদ সেতু ও ফাতিহ মসজিদের নামকরণ করা হয়েছে।
তাইতো ফরাসি জাতীয়তাবাদের কান্ডারি হিসেবে সমাদৃত নেপোলিয়ান বোনাপার্টের চোখে ইস্তাম্বুল ছিল পৃথিবীর সুন্দরতম নগরী। এছাড়াও ইস্তাম্বুলকে পৃথিবীর রাজধানী বললেও ভুল হবে না। কেননা ইস্তাম্বুল ২০১০ সালে ইউনেসকো ঘোষিত এ পৃথিবীর কালচারাল ক্যাপিটালের মর্যাদা লাভ করে।

কৃষ্ণসাগর ও মর্মরা সাগরের সংযোগকারী সংকীর্ণ প্রণালির মধ্যে অবস্থিত ইস্তাম্বুল শহরটাই পৃথিবীর একমাত্র শহর যেটি এশিয়া ও ইউরোপের প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করছে। এছাড়াও এখানে রয়েছে ইউরোপের তৃতীয় ব্যাস্ততম এয়ারপোর্ট ইস্তাম্বুল আতাতুর্ক বিমানবন্দর (ইউরোপ অংশে) ।

বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের কেন্দ্রবিন্দু হওয়াতে তুরস্ক হয়ে উঠেছে বৈচিত্র্যময় একটি দেশ। শহরটি বিশ্বের অন্যতম সুন্দর একটি শহর। ইউরোপ ও এশিয়ার মিলনস্থল হওয়াতে তুরস্কের সংস্কৃতিতে দুই মহাদেশের সংস্কৃতির প্রভাব সমান ভাবে লক্ষ্য করা যায় । পরিকল্পিতভাবে তৈরি এ শহরটি।
দেখতে অনেকটাই স্বপ্নের জগতের মতো।

একবার নেপোলিয়ন বোনাপার্ত বলেছিলেন, “পুরো পৃথিবীকে যদি একটি রাজ্য ভাবা হয়, ইস্তাম্বুল হবে তার রাজধানী।”
অতীতের কনস্টান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) শুধুমাত্র একটি শহরই নয় বরং বলা চলে এটি একটি স্বপ্নপুরী। এশিয়া ও ইউরোপকে একত্রে বলা হয় ইউরেশিয়া, যার বিভাজন রেখা হলো বসফোরাস, আর এই বরফোরাস প্রণালীর অবস্থান প্রাচীন এই ইস্তাম্বুল শহরে।

50% LikesVS
50% Dislikes
Leave A Reply

Your email address will not be published.