আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর থেকেই দেশজুড়ে শুরু হয়েছে নির্বাচনি প্রস্তুতি ও আনুষ্ঠানিকতা। তবে এই নির্বাচনি উৎসবের মাঠে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রার্থী ও রাজনৈতিক কর্মীদের নিরাপত্তা ঝুঁকি। সম্প্রতি বিএনপি মনোনীত প্রার্থী এরশাদউল্লাহ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ওসমান হাদির ওপর সংঘটিত সশস্ত্র হামলার ঘটনা প্রার্থীদের মাঝে তীব্র শঙ্কার সৃষ্টি করেছে, যা নির্বাচনি পরিবেশকে ম্লান করে দিচ্ছে। এমনকি এই নিরাপত্তা শঙ্কাকে কারণ দেখিয়ে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন থেকে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মাসুদুজ্জামান মাসুদ ইতিমধ্যেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।
হামলার ছায়া ও প্রার্থীদের মানসিক চাপ
গত ৫ নভেম্বর চট্টগ্রামের চালিতাতলীতে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী এরশাদউল্লাহর গণসংযোগের সময় গুলিবর্ষণের ঘটনা এবং ১১ ডিসেম্বর ঢাকার পুরানা পল্টনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ওসমান হাদির ওপর প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি হামলা সারাদেশের সম্ভাব্য ও মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে গভীর আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। হাদি বর্তমানে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন। এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, নির্বাচনি মাঠ শান্তিপূর্ণ প্রচারণার পাশাপাশি সহিংসতার একটি অন্ধকার মুখও দেখাচ্ছে। এর প্রভাব সরাসরি পড়েছে প্রার্থীদের কার্যক্রমে। অনেক প্রার্থীই এখন প্রকাশ্য সভা-সমাবেশ ও গণসংযোগে যেতে ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন।
প্রতিক্রিয়া: প্রার্থীদের কণ্ঠে শঙ্কা ও দায়িত্ববোধ
বিভিন্ন দলের প্রার্থীদের কণ্ঠে এই শঙ্কা ও দায়িত্ববোধের মিশ্র প্রতিক্রিয়া শোনা যাচ্ছে।
চাঁদপুর-১ আসনের বিএনপি মনোনীত প্রার্থী এহসানুল হক মিলন সরাসরি বলেন, “নিরাপত্তা নিয়ে আমি শুধু একা নই, প্রত্যেক প্রার্থীই শঙ্কিত।” তিনি ডিপস্টেট ও এক্সটারনাল—দুই ধরনের ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করে প্রস্তাব দেন, প্রত্যেক প্রার্থীর জন্য চারজন করে গানম্যান বা সশস্ত্র দেহরক্ষীর ব্যবস্থা করতে পারে সরকার।
ময়মনসিংহ-১ আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স স্বীকার করেন, “নিরাপত্তার শঙ্কা তো আছেই,” কিন্তু তিনি দায়িত্ব পালনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ— “ভয় পেয়ে বসে থাকলে হবে না। ভয় পেলে তো মুক্তিযুদ্ধ হতো না।”
চট্টগ্রাম-২ আসনের জামায়াতের প্রার্থী অধ্যক্ষ মুহাম্মদ নুরুল আমিনও একই ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করেন, তবে তিনি জানান যে প্রশাসন তাদের খোঁজখবর রাখছে।
চট্টগ্রাম-১০ আসনের এনসিপি প্রার্থী সাগুফতা বুশরা মিশমা বলেছেন, “যারা বাংলাদেশপন্থী না বা সুস্থ ধারার রাজনীতি চায় না, তারা নানাভাবে হামলা করতেই পারে। সেটা মেনে নিয়েই কাজ করছি।”
সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পদক্ষেপ
এই ক্রিটিক্যাল পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেশ কয়েকটি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে:
১. অস্ত্র লাইসেন্স সহজীকরণ: স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে গত সোমবার একটি নীতিমালা জারি করে প্রার্থীদের জন্য আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রাপ্তির প্রক্রিয়া দ্রুততর করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই প্রায় ২০ জন প্রার্থী এই লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছেন।
২. বৈষম্যহীন নিরাপত্তা বেষ্টনী: পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, ঝুঁকির মাত্রা অনুযায়ী প্রার্থীদের তিনটি ক্যাটাগরিতে (অতিঝুঁকি, মাঝারি ঝুঁকি ও কম ঝুঁকি) ভাগ করে নিরাপত্তা দেওয়া হবে। জুলাই যোদ্ধা এবং অতিঝুঁকিতে থাকা প্রার্থীরা অগ্রাধিকার পাবেন। যাদের নিজস্ব সশস্ত্র দেহরক্ষী নেওয়ার সামর্থ্য নেই, তাদের পুলিশের পক্ষ থেকে দেহরক্ষী প্রদান করা হবে।
৩. সমন্বিত পরিকল্পনা: প্রার্থীদের নিজেদের কর্মসূচির আগে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশকে আগাম জানানোর অনুরোধ করা হয়েছে, যাতে তারা পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা নিতে পারেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনারও রাজধানীর প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন।
৪. স্থানীয় প্রশাসনের সতর্কতা: কিশোরগঞ্জের ডিসি মোহাম্মদ আসলাম মোল্লার মতো স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তারা দাবি করছেন যে নিরাপত্তা কমিটি সক্রিয় আছে, তবে এখন পর্যন্ত সরাসরি কোনো আবেদন পাননি।
বিশ্লেষণ: শঙ্কার রাজনীতি ও জনভীতি
এই অবস্থাকে কেবল নিরাপত্তার সংকট হিসেবে দেখলে ভুল হবে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটির একটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে:
জনগণের অংশগ্রহণে ভীতি: সুশাসনের জন্য নাগরিক, রংপুরের সভাপতি ফখরুল আনাম বেঞ্জুর মতো সুশীল সমাজের ব্যক্তিরা আশঙ্কা করছেন, আইন-শৃঙ্খলার এই অনিশ্চয়তা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে সাধারণ ভোটারেরা ভোটকেন্দ্রে যেতে ভীত হতে পারেন, যা নির্বাচনের সার্বিক গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলবে।
নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ: বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম এবং খুলনা-৩ আসনের প্রার্থী রকিবুল ইসলাম বকুলের মতো নেতারা সরাসরি “নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র”-এর কথা বলছেন। তাঁদের বক্তব্যে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নিয়ে সংশয় ও সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে।
অন্তর্দ্বন্দ্ব ও দলীয় অবস্থান: নারায়ণগঞ্জে মাসুদের প্রস্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী একে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত বলে উল্লেখ করেন। এটি প্রমাণ করে, নিরাপত্তা ইস্যুটি দলীয় ও সরকারি মহলে কিভাবে আলাদা আলাদা ব্যাখ্যা পাচ্ছে।
আঞ্চলিক চিত্র: খুলনা, রংপুর ও চট্টগ্রাম
খুলনা, রংপুর ও চট্টগ্রামের প্রার্থীদের বক্তব্যে এই শঙ্কার মিশ্র ও জটিল রূপ ফুটে উঠেছে। খুলনার একাধিক প্রার্থী জেলাকে “খুনের নগরী” বলে উল্লেখ করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির কথা বলেছেন। রংপুরের প্রার্থীরা ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি তুললেও বৈধ অস্ত্রের জন্য আবেদন করেননি, যা হয়তো স্থানীয় পরিস্থিতির একটি আলাদা গতিপথ নির্দেশ করে। চট্টগ্রামে প্রার্থীদের মধ্যে কেউ কেউ নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কামুক্ত আবার কেউ কেউ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
একটি সুষ্ঠু, অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কেবল ভোট গ্রহণের দিনের ঘটনা নয়। এর সফলতা নির্ভর করে নির্বাচনপূর্ব পুরো সময়টায় কী ধরনের পরিবেশ বিরাজ করছে, তার ওপর। প্রার্থী, কর্মী ও সাধারণ নাগরিক—সবার নিরাপত্তা ও স্বস্তি এই পরিবেশ তৈরির মৌলিক শর্ত। সরকার ও নির্বাচন কমিশনের গৃহীত পদক্ষেপগুলো ইতিবাচক। তবে, কাগজে-কলমে নির্দেশ বা নীতিমালা নয়, বরং মাঠ পর্যায়ে তার প্রত্যক্ষ, দৃশ্যমান ও নিরপেক্ষ বাস্তবায়নই প্রার্থী ও জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে। নির্বাচন যদি উৎসব হয়, তবে সেই উৎসবের মাঠ যেন শঙ্কা আর আতঙ্কের ছায়ায় ঢাকা না পড়ে, সেদিকে সকল রাষ্ট্রীয় apparatus-কে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। আগামী দিনগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থার কার্যকারিতা এবং সর্বোপরি, একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনি পরিবেশ নিশ্চিত করাই হবে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

