স্মার্ট বাংলাদেশের বীজ বপন হোক প্রাথমিক শিক্ষায়।

১০

এ এইচ ইরফান উদ্দিন আহমেদ,
উপজেলা নির্বাহী অফিসার, বিজয়নগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

স্বাধীনতার পূর্বে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন কাঠামো ছিলো অত্যন্ত নিম্নমানের। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এঁর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে জন্ম নেয়া বাংলাদেশ যখন পরিকল্পনা করেছিলো বিশ্ব দরবারে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার, তখন স্বাধীনতার মহানায়ক, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাবলেন খেঁটে খাওয়া মানুষের কথা। ভাবলেন তাদের বাচ্চাদের উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথা। তিনি জানতেন এতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি মিলবে।
শিক্ষকদের দুঃখ কষ্ট লাঘব করতে এবং তাদের মধ্যে কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি করতে বঙ্গবন্ধু নিলেন এক দুর্দান্ত সাহসী পদক্ষেপ। ১৯৭৩ সালে প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করে প্রায় দেড় লক্ষ শিক্ষককে সরকারী কোষাগার থেকে বেতন প্রদানের মাধ্যমে ইতিহাস রচনা করলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের শিক্ষার মানোন্নয়নে যা আজও সর্বশ্রেষ্ঠ পদক্ষেপ গুলোর মধ্যে একটি হিসেবে সর্বাধিক প্রশংসিত।
সময়ের বিবর্তনে বাংলাদেশ এখন তার স্বাধীনতার ৫২ বছর পূরণ করেছে। উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলার জয়ের তরী ছুটে চলেছে তরতর করে। রূপকল্প ২০২১ সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। সামনে চ্যালেঞ্জ আছে এসডিজি শতভাগ বাস্তবায়নের। সর্বোপরি ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্র এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী “স্মার্ট বাংলাদেশ” গড়ে তোলা এখন একজন সরকারী কর্মচারী থেকে শুরু করে সকল জনসাধারণের জন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে কাজ করতে গিয়ে উপলদ্ধি করেছি প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু আর কাজ করে যাচ্ছে বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে শেখ হাসিনা সরকার। ২০০৯ সাল থেকে বছরের শুরুতে প্রতিটি শিক্ষার্থীর হাতে রঙিন বই তুলে দেয়ার যেই নিয়ম বর্তমান সরকার চালু করেছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে ২৬ হাজার ১৯৩ টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন। ২০১৪ সালে প্রধান শিক্ষকদের ২য় শ্রেণীর মর্যাদা প্রদান করা হয়। কারণ পিতার মতো তিনিও বুঝতে পেরেছিলেন সামাজিক ও অর্থনৈতিকসহ সকল উন্নয়ন সূচকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য শিক্ষার কোন বিকল্প নেই।
বর্তমান সরকারের সময়ে প্রতিবছরই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বড় ধরনের মেরামত কাজ করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল শিক্ষায় দক্ষ করে গড়ে তুলতে ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়াসহ ইন্টারনেট ডিভাইস চালু করা হয়েছে। প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে ডিজিটাল কনটেন্ট ব্যবহার করে ক্লাসের কার্যক্রম পরিচালনা ও শিক্ষার্থীদের আরও বেশি পাঠদানে মনোযোগী করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। যার সাড়া পাওয়া গিয়েছে দুর্দান্ত। শিক্ষার্থীরা ক্লাসে যেতে অধিক আগ্রহী হয়ে উঠেছে। ঝরে পড়ার হার উল্লেখযোগ্য হারে কমে গিয়েছে। ২০০৫ সালের ডেটা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় তৎকালীন সময়ে শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার ছিলো ৪৭ দশমিক ২ শতাংশ। বর্তমানে তা কমে এসেছে ১০ শতাংশের কাছাকাছি। অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়মুখী হয়েছে। এখন সময় এই মনোযোগকে কাজে লাগানোর। স্মার্ট বাংলাদেশের যেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য সরকার নিরেট পরিকল্পনা করে যাচ্ছে সেই স্বপ্নের মূল সারথি হতে পারে বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা। সে ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষায় প্রণয়ন করতে হবে “স্মার্ট এডুকেশন” সিস্টেম।
স্মার্ট এডুকেশন সিস্টেম শুধু যে ডিজিটাল কনটেন্ট নির্ভর পড়ালেখা এমনটি নয়। স্মার্ট এডুকেশন সিস্টেম অনেকগুলো প্যারামিটার এর উপর নির্ভরশীল। যেমনঃ
১. এই সিস্টেমে ক্লাস ক্যালেন্ডার প্রস্তুত করতে হবে শিক্ষা বছর শুরুর পূর্বেই। সেই অনুযায়ী হবে ক্লাস পরিচালনা, পরীক্ষা ও ফল প্রকাশ।

২. কো-কারিকুলাম কার্যক্রম, ক্রীড়া, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা হবে শিক্ষা ও বিনোদনের মাধ্যম। এ থেকে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা নিবে এবং শারীরিক ভাবে সুস্থ ও সবল থাকবে।
৩. অন্ধ, ডিজেবল ও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের জন্য থাকবে অত্যাধুনিক শ্রেণীকক্ষ।
৪. গতানুগতিক মুখস্থনির্ভর পড়াশোনার পরিবর্তে বাস্তব, কর্মমুখী, সৃজনশীল ও কল্যাণমুখী দেশপ্রেমিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার উদ্যোগ নিতে হবে।
৫. আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি সমৃদ্ধ দ্রুতগতির ইন্টারনেট, আইটি ফ্যাসিলিটিজ, ডিজিটাল কনটেন্ট, ডিজিটাল লাইব্রেরি, ইন্ডাস্ট্রি-অ্যাকাডেমিয়া কোলাবরেশন এবং শিক্ষা শেষে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ ও উদ্যোক্তা হওয়ার নিশ্চয়তা থাকবে।
৬. বাংলা ও ইংলিশ মাধ্যম, ইংলিশ ভার্সন, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাক্রমকে একই ছাতার নিচে আনতে হবে।
৭. সনদ ইস্যু, বেতনভাতা, পরীক্ষার ফি, ফলাফল ইত্যাদি যাবতীয় তথ্য একই আইডি ব্যবহার করে যেকোনো সময় যেকোনো স্থান থেকে এক্সেসযোগ্য হতে হবে। তথ্যসংবলিত ইন্টারেক্টিভ ওয়েবসাইট ও মোবাইল অ্যাপ সংযুক্ত হতে পারে।

স্মার্টকে (SMART) বিস্তৃতি করলে দাঁড়ায় S-Specific : সুনির্দিষ্ট, M-Measurable : পরিমাপযোগ্য, A-Achievable : অর্জনযোগ্য, R-Relevant : প্রাসঙ্গিক, T-Time-Based : সময়ভিত্তিক। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট সময়ে কাঙ্ক্ষিত ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে স্মার্ট এডুকেশন বেশ সহায়তা করে। কাঙ্ক্ষিত ফলাফলের পরিমাণগত ও গুণমান শিক্ষার্থীর শেখার ও বিকাশের জন্য অত্যাবশ্যক। আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত সময়সীমা ঠিক থাকলেও উচ্চশিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সময়সীমা ঠিক রাখা অনেকটাই কঠিন হয়। শিক্ষা কারিকুলামের সঙ্গে কর্মক্ষেত্র কিংবা ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গেও রয়েছে বিস্তর ফারাক। রয়েছে প্রাসঙ্গিকতা ও অর্জনে অনেক ব্যর্থতা। বাস্তব ও কর্মমুখী শিক্ষার অভাবেই এমনটি হয়ে আসছে। তবে আশার আলো এই যে, সম্প্রতি প্রণীত নতুন কারিকুলামে উপরিউক্ত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও কর্মোপযোগী স্মার্ট এডুকেশনের রোডম্যাপ দেওয়া হয়েছে। যার সঠিক বাস্তবায়নের ফলে স্মার্ট এডুকেশন নিশ্চিত করা অনেকটাই সহজ হবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে আর সেই রোডম্যাপে নেতৃত্ব দিবে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ এমনটাই প্রত্যাশা।

 

100% LikesVS
0% Dislikes
Leave A Reply

Your email address will not be published.