অশান্ত সংসার

১৩০

লেখক: ইমরান হোসেন পিয়াল।

-ইভা ইরা দুই জমজ বোন। ওদের বাবা জনাব ফোরকান সাহেব খুব অসুস্থ। তার শুধু চিন্তা কখন মা মরা মেয়ে দুটিকে বিয়ে দিবে। তারপর চোখ বুঝে বিদায় জানাবে এ পৃথিবীকে। তিনি দ্বিতীয় শ্রেনীর সরকারী কর্মকর্তা থাকলেও দুই বছর আগে অবসর নেন। তার সহধর্মিণী মিসেস ফোরকান ওরফে আছিয়া খাতুন ছয় বছর পূর্বে মারা গেছে। তিনিই বর্তমানে ইভা-ইরার বাবা-মা।ইভা-ইরার চেহারা একই রকম। ওরা সবসময় একই রকম পোশাক পড়ে। আর ওদের দেখলে যেকোন কেউই ওদের প্রেমে পড়ে যাবে।

ইমরান তরুণ ব্যবসায়ী হলেও সমাজসেবক। তিনি জনকল্যাণমূলক অনেক কাজ করেন। বর্তমান সমাজে তার অনেক নামডাক। সকলের কাছে তিনি অত্যন্ত ভাল মানুষ হিসাবে পরিচিত।

একদিন ইভা-ইরা ওদের বান্ধবীদের সাথে নাচ করতে ছিল। হঠাৎ ইরা সেখান থেকে চলে গেল বাবা ডাক দিয়েছে বলে। ওই পথ দিয়ে ইমরান সাহেবকে আসতে দেখে ইভাকে একা রেখে সব বান্ধবীরা চলে গেল,আর ইভা একমনে নাচতে ছিল। ইমরান সাহেব অনেকক্ষণ ইভার নাচ দেখল এবং নাচ শেষে বলল-
বাহ ! চমৎকার ! অসাধারণ। কি অসাধারণ তোমার নৃত্য।
অাচ্ছা। অসাধারণ? কি অসাধারণ? আমার নৃত্য?
হুম।
তাহলে আমি তো নই। এই বলে ইভা দৌড়ে পালালো।

ইমরান সাহেব ওইদিনই ইভার বাড়ির ঠিকানা বের করল। তারপর ফোরকান সাহেবের সাথে কথা বলল। ফোরকান সাহেব ইমরান-ইভার বিয়ে সম্মতি দিলো।ইরা সমস্ত বাড়িকে নতুন করে সাঁঝাতে লাগলো। ফোরকান সাহেবের মুখে হাসি থাকলেও ইভা-ইরার মুখে কোন হাসি নেই। ওদের মনে রাজ্যের বিষণ্ণতা। ওরা যে দুই শালিক,আর কিছুদিনের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে। ওরা একা থাকলেই কান্না শুরু করে দেয়। ইরা সমস্ত কাজ নিজ হাতে গুছিয়ে নিতে লাগলো। কেননা বাড়ি মা নেই,তাই যেন তিনি এ রাজ্যের মহারাণী।

দেখতে দেখতে ইভার বিয়ের দিন চলে এল। সব আত্মীয়স্বজন ইরাদের বাড়ি আসলো। গ্রামের ছোট্টছোট্ট ছেলেমেয়েরা নাচগান করতে লাগল।
দুুপুর বেলা বর আসলো। বরযাত্রীরা খাওয়াদাওয়া শেষে কনে নিয়ে রওনা দিলো। সেই সময় সারা বাড়ি খোঁজাখুঁজি করেও ইরাকে পাওয়া গেল না।

কয়েকবছর হয়ে গেল ইভার বিয়ে হয়েছে। ফোরকান সাহেবের শরীরটা আর আগেরমত নেই। ইরা সারাদিন বাবার সেবায় ব্যস্ত থাকে। ইরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়নি আজও বাবার সেবা করবে বলে। হঠাৎ করে ইভার চিঠি আসলো-
‘প্রিয় শালিক
আমি ভাল নেই। অনেকবছর হয়ে গেল আমাদের কোন সন্তান হল না। তিনি মুখে কিছু না বলে শান্তনা দিলেও বুঝতে পারি তিনি যেকোন ভাবেই একটা সন্তান চায়।
তোরে খুব মনে পড়ে ইরা,আমার মরার সময় একবার হলেও দেখতে আসিস। আর বাবার যত্ন নিস।
ইতি বাহুহীন শালিক’

কয়েকদিন পরে ফোরকান সাহেব রোগাক্রান্ত হয়ে মারা গেল। ইরার পাশে এখন আর কেউ নেই। ইরা ইভার চিঠিটা বের করে অঝোরে কান্না করতে লাগলো। ইরা সিদ্ধান্ত নিল ইভাদের বাড়ি যাবে। কিন্তু ইমরান সাহেব জানেনাতো তার ইরা নামে একজন শালিকা আছে। ইরা কাজের লোক হিসাবে ইমরান সাহেবের বাড়ি ঢুকলো।

ইমরান সাহেব সবসময় কি যেন চিন্তা করে। সবসময় যেন সন্তান প্রার্থনা করে। ইশ ইভার যদি দুইটি বাবু থাকতো,তাহলে তো ইমরান সাহেব এমন প্রার্থনা করত না ইরা মনেমনে ভাবে। ইভার মুখে আগের মত আর হাসি নেই,প্রতিমুহূর্তে যেন ইমরান সাহেব ওর কাছে সন্তান চায়। ইরা কি যে করবে তা ভেবে পায়না?
দিদি আমি তোর কষ্ট সইতে পারিনা।
কি করবি তুই বল? সবই সৃষ্টিকর্তার রহমত।
দিদি আমি ইমরান সাহেবের সাথে রাত কাটাবো তুই যদি কিছু মনে না কর।
ইরা তুই কেন তোর সুন্দর জীবনটা আমার জন্য নষ্ট করবি?
দিদি আমি তোর এমন মুখ দেখতে পারবো না,তুই অনুমতি দে।
যাহ। যা ইচ্ছা করে তা কর তুই।

ইরা ইমরান সাহেবের সাথে প্রথম রাত কাটালো,পরেরদিন ইমরান সাহেবকে খুবই খুশী মনে হল। এভাবে ইমরান সাহেবের সাথে ইরা রাত কাটাতে শুরু করল। ইরা রাতে হয় ইভা আর দিনে কাজের মহিলা।

ইভা দেখতে লাগলো ইমরান সাহেব নকল ইভাকে পেয়ে অনেক খুশি আর ইরা বোনের মুখে হাসির জন্য নিজের ইজ্জত বিলিয়ে দিতেও দ্বিধা করে নাই। একসময় ইভার ইমরান সাহেবের উপর ঘৃনা হত,কিন্তু এখন আর হয়না। ইরা ও ইমরান সাহেবের জীবন থেকে নিজেকেই লুকিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এমন কিছু করতে হবে যাতে ইরা আমাকে ঘৃনা করে ইভা ঠিক করল,তা নাহলে ইরা ও ইমরান সাহেব কখনো সুখী হবেনা। ইরাকে একটা চিঠি লেখে রাতে বাড়ি ছেড়ে চলে যায় ইভা।

‘প্রিয় শালিক
তোর মুখোমুখি আমি কখনো হতে পারবো না। তোর মত মহৎ আমি কখনো হতে পারবো না। তুই এতই মহৎ যে,আমার স্বামীকে কেঁড়ে নিতে দ্বিধা কর নাই। তোর মত বোনকে শুধুই ঘৃনা করা যায় মন ভরে। ছিঃ ছিঃ তুই তো আমার বোনই না। যদি পারো ওনাকে ভাল রাখিস।
ইতি অভাগিনী নারী’

ইরা চিঠি পড়ে কান্না করতে লাগল আর ভাবতে লাগল এটা শুধু ইভার অভিনয়। আমাকে আর ইমরান সাহেবকে একসাথে রাখার জন্য ওর ত্যাগ। আমি কখনোই আর ইমরান সাহেবের রাতের সঙ্গিনী হব না।

ইভা পথিমধ্যে যাওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়ল। বুবলির মা তা দেখে বুবলির বাবাকে ডাক দিলো এবং দুজনে ইভাকে ঘরে নিয়ে গেল। ইভা যে গর্ভবতী ছিল তা ইভা ছাড়া কেউ জানতো না। ইভা এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেয় এবং নিজ ছেলের গলায় স্বামীর দেওয়া রকেটটা পরিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর ইভা মারা যায়। বুবলির বাবা ইভাকে দাফন দিয়ে ইভার পুত্রসন্তানকে বাজারে আনে অন্যকে দত্তক দিয়ে দিবে বলে। ইরা এখন অন্যরকম হয়ে গেছে বলে ইমরান সাহেব ওই ছেলেকে দত্তক নেয়। ছেলেটির নাম রাখে বাহাদুর। হঠাৎ ইমরান সাহেব বাহাদুরের গলায় নিজের তৈরি করা রকেট দেখতে পায়। সে বাড়িতে গিয়ে ইরাকে প্রশ্ন করে এ রকেট ওর গলায় কিভাবে?
ইরা কিছুই বলতে পারলো না।


আমি তোমাকে বলেছিলাম এ রকেট আমার আর তোমার ভালবাসার বন্ধন। আর এ রকেট বাহাদুরের গলায়,আমার জানামতে তো আমার সন্তান নাই। তাহলে কে তুমি?
ইরা চিৎকার করে বলল আমি ইরা। ইভার জমজ বোন,যার কথা আপনি জানেন না। আপনি যেন ইভাকে কষ্ট না দিতে পারেন সেজন্য আমি আপনার রাতের সঙ্গী হতাম আর দিনে কাজের লোক।
এ তুমি কি বললা? আমাদের পবিত্র ভালবাসার মধ্যে তোমার মত মহৎ মানুষ কেন এসে আমাকে অমানুষ বানিয়ে দিলে? ইভা কি কখনো আমাকে ক্ষমা করবে? এ সন্তান ইভার,আমার আর বাহাদুরের মধ্যে তুমি আসতে পারবে না।
ইরা কান্না করতে করতে সেখান থেকে চলে গেল।

ইমরান সাহেব নেশা করতে করতে আজ মাতাল হয়ে গেছে। তার পৃথিবীটা শুধুই ইভাময় হয়ে গেছে।

ইরা এ বাড়ি থেকে চলে যেতে লাগল। হঠাৎ মাতাল ইমরান সাহেবের সামনে পড়ল-
ইরার হাত ধরে ইমরান সাহেব মাতাল অবস্থায় বলল কোথায় যাচ্ছ ইভা?
ছেড়ে দিন। ছেড়ে দিন আমাকে। আমাকে যেতে দিন।
তুমি আর আমি যে স্বপ্ন দেখতাম,তার কি হবে? তুমি যেয়ো না,আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না। আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি।
আমি তো ইভা নই,আমি ইরা।
আমি জানতে চাইনা তুমি ইভা না ইরা? তুমি শুধু বাহাদুরকে পালন করবে।

100% LikesVS
0% Dislikes
Leave A Reply

Your email address will not be published.