বাংলাদেশের শ্রমিকদের ডলারে বেতন দিতে চায় ক্রেতারা,মালিকদের না।

৫৫

শ্রমভিত্তিক উৎপাদনশীলতায় বাংলাদেশ কেন পিছিয়ে পড়ল?

তৈরী পোশাক শিল্পে শ্রমভিত্তিক উৎপাদনশীলতায় এখনো প্রতিযোগী দেশ গুলোর তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রতি ঘণ্টায় উৎপাদনশীলতা যেখানে ৩.৪০ ডলার এবং সেখানে এক নম্বর রপ্তানিকারক চীনের উৎপাদনশীলতা ১১.১০ ডলারে রেকর্ড করা হয়েছে।

শুধুমাত্র কম্বোডিয়া ছাড়া, দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখনও প্রতি ঘন্টায় শ্রমভিত্তিক উৎপাদনশীলতায় সাতটি এশিয়ান প্রতিযোগীদের থেকে পিছিয়ে রয়েছে।

আমাদের দেশের প্রত্যেকটা সফল কারখানার মালিক কর্মকর্তা কর্মচারী এখন শুধু মাত্র এই একটা বিষয়েই সাফল্যের জন্য সকল ধরণের চেষ্টা চরিত্র চালাচ্ছেন। কিন্তু মূল একটা বিষয়ে আমি একমত হতে পারছিনা। আমরা সবচেয়ে বেশি সিইও, ইডি, আইই জি এম, ম্যানেজার নিয়োগ করেছি যে দেশ থেকে সেই দেশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাগণ যে কারখানা গুলোতে বড় পদে অধিষ্ঠিত আছেন সেই কারখানা গুলোর ও কিন্তু প্রোডাক্টিভিটি তেমন একটা চোখে পড়ার মত ভাল না! তাহলে দোষ কি আমাদের দেশের পুরো ইন্ডাস্ট্রির ইকো সিস্টেম প্রতিষ্ঠায় আমাদের সার্বিক ব্যর্থতা?

যাইহোক, সরকারী সংস্থা গুলো দাবি করে যে ১৯৯৫ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে দেশের সামগ্রিক শ্রম উত্পাদনশীলতা বেড়েছে ৩.৮০% এবং এশিয়ান প্রোডাক্টিভিটি অর্গানাইজেশনের (এপিও) তথ্য উদ্ধৃত করে, শিল্প মন্ত্রণালয় বলেছে যে ২০ টি এশিয়ান দেশ এই সময়ের মধ্যে উত্পাদনশীলতা ২.৫% বৃদ্ধি পেয়েছে।

এশিয়ান প্রোডাক্টিভিটি অর্গানাইজেশন এর তথ্য অনুযায়ী। প্রতি ঘণ্টায় উৎপাদনশীলতার সমীক্ষা নিম্নরুপঃ

শ্রীলঙ্কা $১৫.৯ ,

ইন্দোনেশিয়া $১২.৩০,

চায়না $১১.১

ফিলিপাইন $৮.৭,

ইন্ডিয়া $৭.৫,

ভিয়েতনাম $ ৪.৭,

মায়ানমার $৪.১

বাংলাদেশ $৩.৪

যে সকল কারণে আমাদের দেশের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ গুলোর ইফিসিয়েন্সি সবচেয়ে নিম্ন মানের তথা আমাদের ইন্ডাস্ট্রির ইফিসিয়েন্সি এতটা প্রশ্নবিদ্ধ তার কিছুটা ব্যাখ্যা তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

১। তুলনামূলক কম বেতন জন্য শ্রমজীবী মানুষ গুলোর মাঝে একধরণের হতাশা লেগেই ছিল। কিন্তু তার চেয়ে ভয়াবহ হল আমাদের পত্র পত্রিকা, সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা শ্রমিক সংগঠন গুলোর ভুল মেসেজ, উসকানি মূলক মেসেজ মূলত এই শ্রমজীবি মানুষ গুলোকে শুধু আক্ষেপ জন্ম দিতে সাহায্য করেছে। কিন্তু তাদের উপলব্ধিকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করার কাজটা আমরা কেউই করতে পারিনি। কিভাবে বেকারত্বের যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করে তাদের এই আয়ের ব্যবস্থা করেছে এই ইন্ডাস্ট্রি। কিভাবে তাদের স্বাবলম্বী করে তুলে আজকের এই অবস্থানে নিয়ে এসেছে এই মিনিমাম ওয়েজ, আজকের দিনের আমাদের ৪৫ বিলিয়ন রপ্তানী না থাকলে দেশ ও জাতির দুর্দশা কোথায় গিয়ে ঠেকত! পজিটিভ ভাবে এই মার্কেটিংটা করতে আমাদের মিডিয়া, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, সরকারী সংস্থা কিংবা আমাদের প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ এইচআর টিম, প্রোডাকশন টিম, টপ ম্যানেজমেন্ট টিম দারুণভাবে ব্যার্থ হয়েছে।

২। আমরা মূলত তুলনামূলক স্বস্তা প্রোডাক্টের কাজ করি তাই স্বস্তা মজুরি পাই, তাই আপনাদের কাজের প্রেশার ও কম থাকে, তাই আপনাদের বেতন ও তুলনামূলক কম পেয়ে থাকেন। কাজ ভাল করেন এবং আরো বেশি ক্রিটিক্যাল অর্ডার সামাল দিতে পারলে বেতন স্বাভাবিক ভাবেই বাড়বে। এই ধরণের ক্লিয়ার মেসেজ প্রদান করতে আমরা দ্বায়িত্বশীল প্রত্যেকটা মানুষ ও সংস্থা সকলেই কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। ইন্ডাস্ট্রি থেকে রুটিরুজি গ্রহণকারী প্রত্যেকটা কর্মকর্তার উপরে এই দ্বায়িত্ব বর্তায়। গত কয়েক মাসে ৩০০ এর মত কারখানা বন্ধ হওয়ার পিছনে আপনার আমার সকলের দায় আছে কিন্তু !

আমাদের মজুরী বোর্ড, সরকার, মালিক সংগঠন, বিভিন্ন এনজিও, শ্রমিক সংগঠন সহ প্রতিটি প্রতিষ্ঠান কিন্তু মজুরীর সামঞ্জস্যতা প্রদানের জন্য প্রত্যেক সময়ে কিছু না কিছু উন্নতি সাধন করেই যাচ্ছেন। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া এবং উন্নয়নশীলতা ও উৎপাদনশীলতার সাথে সামঞ্জস্য রেখেই তো এই ব্যাপারে বিশ্লেষণ গুলো করা হয়। বেতন বাড়ানো কমানোর পক্ষে বিপক্ষে না গিয়ে ভুল মেসেজটা যাতে আমরা আর না বৃদ্ধি করি এই ব্যাপারে সচেতনতার আহবান জানানোর চেষ্টা চালাচ্ছি।

৩। আমরা যারা অতি আবেগী এবং উৎসাহী হয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নেগেটিভ নিউজ গুলো, শ্রমিক শোষণের নিউজ গুলো শেয়ার করতে পছন্দ করি তারা এক ধরণের বিভ্রান্তিমূলক জ্বালা মেটাই। আমাদের নিজেদের ইনিফিসিয়েন্সির দিকে কখনই আমরা তাকাই না। নিউজ শেয়ার করে আমরা বিশাল ভাবে শোধ নিয়ে নিলাম বলে এক ধরণের বিভ্রান্তিতে লিপ্ত। এই ইন্ডাস্ট্রিটা না থাকলে ৮ লক্ষ শিক্ষিত বেকারের পাল্লা ভারী হয়ে ৮০ লক্ষ তে চলে যেত আজকের বাংলাদেশ। এই ইন্ডাস্ট্রি না থাকলে আমাদের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারতনা। আজকে আমরা যত ধরণের ফুটানী তে লিপ্ত তার কোনটাই আমাদের ভাগ্যে জুটতনা। ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৯০ সালের পুরাতন বাংলাদেশের বেকারত্বের সংবাদগুলো এখনো আর্কাইভ ঘাটলে দেখতে পারবেন।

৪। আমরা যারা অফিস লেভেলে চাকুরীরত তাদের সকল ধরণের সাপ্লাইচেইন ইন-ইফিসিয়েন্সি মূলত আমাদের প্রোডাকশন ব্যবস্থাকে সকল সময় নাস্তানাবুদ করে রাখে এবং চাপের মুখে রাখে, অযথা বাড়তি ওভারটাইম দিতে বাধ্য করে। শিপমেন্ট ডিলে কখনই প্রোডাকশনের জন্য হয়না, প্রোডাকশন সঠিক সময়ে শুরু না করা জন্য হয়। ইন্ডাস্ট্রির আজকের ইন-ইফিসিয়েন্সির জন্য এই ঘটনা গুলো ৮০% দায়ী বলে আমি মনে করি। কিন্তু আমরা বোকার মত প্রোডাকশনের উপরে দায়ভার চাঁপিয়ে দারুণ এক ভ্রান্তিতে লিপ্ত।

৫। টোটাল বিজনেস ইন-ইফিসিয়েন্সির এই বিষয়টা নিয়ে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে সার্বিক ভাবে কোন ধরণের সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। সরকারী, বেসরকারী সংস্থা, বিভিন্ন এনজিও এবং এইড প্রাপ্ত সংস্থা গুলো দায়সারা গোছের প্রজেক্ট সম্পন্ন করে গেছে। আমাদের প্রতিষ্ঠান গুলো ও দায়সারা ভাবে প্রজেক্ট সমাপ্তির দিকেই তাকিয়ে ছিল। এর থেকে বেনিফিট নেয়ার কোন কাজ উভয় পক্ষই করেন নাই।

এই প্রজেক্ট গুলো সাইন করার সময় আমরা খেয়াল করিনা যে বিদেশি কয়েকটা চিহ্নিত সংস্থা এই প্রজেক্ট গুলো থেকে কোটি টাকার বাণিজ্য করে টাকাটা বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে এবং মূলত ইন্ডাস্ট্রিতে কোন ধরণের পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হচ্ছে। আর ইন্ডাস্ট্রির অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ ও সংবেদনশীল তথ্য গুলো তাদের হাতে আমরা তুলে দিচ্ছি। উক্ত স্বনামধন্য কোম্পানিগুলোর সাথে কাজ করার আগে আমাদের সাবধান হওয়ার সময় এসেছে।

৬। দেশী বিদেশী চিহ্নিত কিছু মিডিয়া, কিছু পত্রিকা, কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব অনবরত আমাদের ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে কুৎসা রটনাতে লিপ্ত। এই সকল প্রতিষ্ঠানের লোকজন আমাদের দেশে অবস্থান করে আমাদের ইন্ডাস্ট্রির লোকজনের কিছু ইন্টারভিউ ছাপে, আর আমাদের নেতাগণ সাথে সাথেই অন্ধত্বমূলক আচরণ শুরু করে দেন। বিদেশী চিহ্নিত সংস্থা গুলো এবং বিদেশী মিডিয়ার লোকগুলো গুলশানে হোটেল ভাড়া করে থাকে মূলত আমাদের টাকায়। আমরা সরকারী বেসরকারী সকল সংস্থা গুলো এই ব্যাপারে দৃঢ় ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছি। বিজিএমইএর গত কমিটি অবশ্য একবার একটা বিষয়ে দারুণ ভাবে অফিসিয়াল প্রতিবাদ করেছিল। সম্প্রতি ওয়ালমার্টের মালামাল ফেরত দেয়ার ব্যাপারে কয়েকজন একটু নড়েচড়ে অবশ্য বসেছিলেন। এছাড়া আর কোন ইনিশিয়েটিভ আমার চোখে পড়েনি।

৭। আমাদের দেশি মিডিয়া গুলো পরীমনিকে নিয়ে যেভাবে খবর ছাপায় ঠিক সেই মেধা দিয়েই ইন্ডাস্ট্রির ছোট্ট একটা নেগেটিভ খবরকে ছাপিয়ে কাটতি ভাল করার এক জঘণ্য কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। আর আমরা তো ফোন নিয়ে বসেই থাকি ঝাঁল মিটানোর জন্য, ইন্ডাস্ট্রির নামে যে কোন নেগেটিভ নিউজ শেয়ার করতে আমাদের শরীরে এক আক্রোশের জোশ চলে আসে। আমরা শিক্ষিত শ্রেণীর মানুষ গুলো কি কোনদিন সজাগ হতে পারবনা, ভীষণ আফসোস লাগে।

৮। আমাদের প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ ইফিসিয়েন্সি বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ কিংবা প্রয়াসগুলো ছিল শুধু মাত্র অপারেটর তৈরী করে চালিয়ে নেয়ার জন্য। প্রোডাকশনের ইফিসিয়েন্সি বাড়ানোর জন্য, ব্যক্তিগত ইফিসিয়েন্সি বাড়ানোর জন্য কোন কাজ মূলত করাই হয়নাই। এই ব্যাপারে প্রত্যেকটা কারখানাকে আলাদা ভাবে প্রজেক্ট আকারে কাজ শুরু করতে হবে। দিন শেষে দেখেছেন তো মিডিয়া, সরকারী বেসরকারী সংস্থা, বায়ারের প্রতিনিধি কেউই আমাদের প্রয়োজনে এগিয়ে আসেনা। এই ইন্ডাস্ট্রিটা কে আপনি ব্যক্তি উদ্যোগে যতদূর টেনে এনেছেন সেটাই এই ইন্ডাস্ট্রির আজকের সাফল্যের রুপ।

৯। অটোমেশনে আমরা ইনভেস্ট করার ব্যাপারটা ঠিক মত বুঝে উঠতে পারছিনা। একটা ইআরপি আর সুইং লাইনের মাথায় আরএফআইডি ত্যাগ লাগানো মানেই কারখানা অটোমেশন করা না। একটা কথা আপনাদের স্বীকার করে নিতে হবে যে এবার তো আমাদের সামনে অটোমেশন ছাড়া আর কোন রাস্তা খোলা থাকলনা। আমাদের ইন্ডাস্ট্রির প্রত্যেকটা প্রসেসে অটোমেশন, সেমী অটোমেশন কিংবা সফট অটোমেশন সম্ভব। প্রত্যেকটা প্রসেস বলতে আমি প্রায় ২৫০ টার মত প্রসেসের সকল ধরণের সম্ভাব্য অটোমেশনের কথা বলছি। এই ব্যাপারটাতে আমরা যথেষ্ঠ গাফিলতি করে ফেলেছি। আর কোন সময় ক্ষেপন করা উচিত না।

১০। আমাদের দেশের অনেক কারখানায় উৎপাদনশীলতায় এক নম্বরে থাকা দেশটার নামি এবং দামী সিইও, ইডি, আইই জি এম, ম্যানেজার নিয়োগ করা আছে। সেই দেশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাগণ যে কারখানা গুলোতে বড় পদে অধিষ্ঠিত আছেন সেই কারখানা গুলোর ও কিন্তু প্রোডাক্টিভিটি তেমন একটা চোখে পড়ার মত ভাল না! তাহলে দোষ কি আমাদের দেশের পুরো ইন্ডাস্ট্রির ইকো সিস্টেম প্রতিষ্ঠায় আমাদের সার্বিক ব্যর্থতা? আপনারা কি একটু অনুগ্রহ করে আপনাদের ওই সকল হেভিওয়েট কর্মকর্তাদের সাথে একটা পর্যালোচনামূলক সেশন করতে পারেন যে কেন আমাদের দেশে আমরা পারছিনা, কেন উনিই বা এই কারখানায় ওই ধরণের কালচার প্রতিষ্ঠা করতে পারছেন না? আমার তো মনে হয় একজন উদ্যোক্তা এই ধরণের আশা নিয়েই এত টাকা দিয়ে বিদেশী কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিয়ে থাকেন !

একটা ইন্ডাস্ট্রির ইকোসিস্টেম দাঁড়া করানোর জন্য এইরকম অনেকগুলো কাজের কথা আমার আগের অসংখ্য আর্টিকেলে বলার চেষ্টা করেছি। সময় থাকলে একটু পড়ে দেখতে পারেন।

আমাদের মূল রপ্তানিমুখী ইন্ডাস্ট্রি কে সুদূরপ্রসারী টেকসই এবং দৃঢ় ভিত্তির উপরে দাড় করার প্রয়াসে আমাদের সকলের এগিয়ে আসা জরুরী হয়ে পড়েছে। কোন মিটিং ডায়ালগের মাধ্যমে এর কোন সুরাহা হবেনা। প্রত্যেকটা কারখানা কে তার ইফিসিয়েন্সি উন্নয়নে একক ভাবে কাজ করতে হবে। আপনারা বিগত ৪০ বছর এই কাজটা একাই করেছেন।

100% LikesVS
0% Dislikes
Leave A Reply

Your email address will not be published.