প্যারেন্টিং : বিষয়টা কতোখানি গুরুত্বপূর্ণ ?

৬৪

লেখক ও বিশ্লেষক: মো: সালেহীন ফেরদৌস।
সহকারী অধ্যাপক, ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ।
ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।

প্রতিটা পিতামাতার মাঝে যে ভালোবাসা জৈবিক চাহিদার তাড়নায় তৈরি হয়,সেই ভালোবাসার চূড়ান্ত রূপ হচ্ছে সন্তান।
একজন সন্তান যেমন নতুন মানুষ হিসেবে একদম নতুন ভাবে এই পৃথিবীতে আসে, ঠিক সেই সন্তান জন্মের পর পরেই একজন বিবাহিত দম্পতির বাবা-মা হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে।
প্যারেন্টিং বিষয়টা এইখানে ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ-যথাযথ প্যারেন্টিং এর মাধ্যমেই একটি ভবিষ্যত প্রজন্ম নির্ভর করছে।
আমি ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করছি প্রায় ১৩ বছর ধরেই।
কাজের সূত্র ধরেই অনেক কলিগ আমার হয়েছে।
একদিন পরীক্ষা চলাকালীন সময় পরীক্ষার হলে ইনভিজিলেশন ডিউটি দিচ্ছিলাম। আমার সাথে ছিলেন ইউনিভার্সিটির টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান নাজরিমা সুলতানা।
নাজরিমা সুলতানার একটি মাত্র ছেলে ক্লাস ৫ এ পড়ে।
বাড়ন্ত বয়স ছেলের- অফিসের জন্য ছেলেকে সময় যথাযথভাবে দিতে পারছেন না,এই আক্ষেপ উনার প্রায়দিনই থাকে।
নানা কথায় উনি বলেছেন,” যদি ক্যারিয়ার এবং সন্তানের মাঝে একটা বেছে নিতে হয়,আমি সন্তানকেই বেছে নিবো।
আমি যদি ভালো খাই,আমার শরীর ভালো থাকবে। আমি স্কিন এর যত্ন নিলে আমার স্কিন ভালো থাকবে।ঠিক তেমনি-আমি যদি আমার ছেলের যত্ন নেই,আমার ছেলে ভালো থাকবে।
আর ছেলে বেস্ট করবে-এটাই সকল পিতামাতার চাওয়া।”
বাড়ন্ত বয়সী একজন সন্তানের জন্য তার পিতামাতার কেয়ার খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।কারন,বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ক্লাস ৪ কি ৫ এ থাকতেই ছেলে কিংবা মেয়েদের বয়:সন্ধি চলে আসে।
শারীরিক বদলের সাথে সাথে মানুষিক বদল খুব দ্রুতই হয়।
সন্তান তখন পিতামাতাকেই কাছে চায়।
এই সময় সামান্য ভূল পিতামাতার সাথে সন্তানের দূরত্ব অনেকখানি বাড়িয়ে দিতে পারে-যা কোনদিন ঘুচবার নয়।
আমাদের সাথে আমাদের পিতার দূরত্ব অনেকখানি বেড়ে গিয়েছে এই বয়:সন্ধির সময় এবং অতিরিক্ত পিতাসুলভ শাসনের কারনে। এই দূরত্ব এখনো ঘুচে নি।
অপরপক্ষে আমাদের আম্মার সাথে আমাদের ভাইদের রিলেশনটা বন্ধুর মতোই।
আম্মার সাথে বন্ধুর মতোই সব শেয়ার করি।
আমাদের আম্মা ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে পলিটিক্যাল
সায়েন্সে অনার্স এবং মাস্টার্স পাশ করে আমাদের জন্ত নিজে ক্যারিয়ার জলাঞ্জলি দিয়েছেন। পুরাদস্তর সংসারী একজন মহিলা হয়ে একহাতে সংসার সামলেছেন আর একহাতে আমাদের মানুষ করেছেন।
যার কারনে আমি আজকে এই অবস্থানে দাড়িয়ে আছি আজকের এই দিনে।
২০২৩ সালের ১৪ই মে,মা দিবসে আম্মা পেয়েছেন
“রত্নগর্ভা মা ” এর সম্মাননা।
আমাদের ভাইদের পক্ষ থেকে আম্মাকে দেয়া শ্রেষ্ঠ পুরস্কারের একটা।
বেশ কয়েকদিন আগে দেখলাম-ফেসবুকে একটা পোস্ট বেশ ভাইরাল হয়েছে,যার শিরোনাম ছিলো,” আমাদের নানী দাদিদের ৮/১০/১২ টা সন্তান মানুষ করতে পারে।আমরা ১/২ টা সন্তান মানুষ করতে পারি না।”
আমাদের নানীদাদির সময় আর আমাদের সময়টা বেশ আলাদা।
সেই সময় একান্নবর্তী পরিবার ছিলো।আমাদের এই যুগে একান্নবর্তী পরিবার এখন আর নেই। নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি হয়ে গিয়েছে সবই।
তার উপর হাজব্যান্ড ওয়াইফ দুইজনই চাকুরীজীবী।সারাদিন অফিস করে সন্তানকে দেয়ার মতো সময় হাতে আর থাকে কই?
বেচারা সন্তান বাবা কিংবা মা-কাওকেই পায় না।
যে বয়সে পিতামাতাকে বেশী প্রয়োজন,সেই বয়সে একলা হয়ে যায়। একলা বড় হয় অথবা কাজের লোকের কাছে বড় হয়।
এই কারনে হয়তো আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রম এর সংখ্যা বাড়ছে।
একটা বিষয়কি খেয়াল করেছেন?
চিত্রনায়িকা পরীমনীর সন্তান হবার আগের জীবন এবং সন্তান হবার পরের জীবন।দুইটা জীবন কতো আলাদা
আমি বলছি না যে, পরীমনি খুব ভালো একজন মানষ।
মা হবার আগে তার অনেক স্ক্যাডাল ছিলো।কিন্তু মা হবার পরে সেই স্ক্যান্ডালগুলা এখন আর নাই।
হয়তো ছেলে রাজ্য এর কথা ভেবেই সে নিজেকে বদলে নিয়েছে।
সন্তান প্রতিপালন বিষয়টা খুব একটা সহজ বিষয় নয়।অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়।
অনেক সচেতন হতে হয়।
আমার ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজী বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান নাফিসা আহসান নিতুর একটা ঘটনা বেশ মনে পড়ছে।
মেয়ে ক্লাস ১০ এ পড়ে। অংকে একটু কাচা।
একবার পরীক্ষায় খারাপ করার পরে দেখলাম নাফিসা আহসান নিতুর ঘুম প্রায় হারাম হয়ে গেলো।
প্রচন্ড গরমে মেয়েকে এয়ারকুলার কিনে দেয়া হয়েছে।মেয়ে এখন এসি চাচ্ছে।
আমি বললাম,” কিনে দেন।”
উনি উত্তর দিলেন,” মেয়ের উঠতি বয়স।এসি চাইলেই কিনে দিতে পারি।কিন্তু এসি কিনে দিলে মেয়ে সারাদিন রুমের দরজা বন্ধ করে কি করবে,সেটা বেশ বড় চিন্তার বিষয়।আর চাইলে সব কিছু কিনে দিতে নেই। অনেক কিছু অনেক সময় স্যাক্রিফাইস করতে হয়।এটা শেখা উচিত মেয়ের।”
আমি ভেবে দেখলাম-কথাটা উনি ভূল বলেন নি।
কিছু কিছু সময় সন্তানকে চাইলেই সব কিছু দিতে নেই।
এটা শেখানো উচিত-কিছু মানুষ আমাদের থেকেও অনেক সমস্যায় আছে।

আমাদের নানীদাদিদের যুগ আর নেই। যুগ পাল্টেছে।
সাথে পাল্টেছে প্যারেন্টিং এর ধরন।
নানা ইলেকট্রনিক গ্যাজেটস এর ভিড়ে সন্তানকে বড় করে মানুষ এর মতো মানুষ করে তোলা আজকের আধুনিক যুগে বেশ বড় চ্যালেঞ্জ।
আসুন,একটু সচেতন হয়ে একটা সুন্দর ভবিষ্যত প্রজন্ম গড়ে তুলি।

100% LikesVS
0% Dislikes
Leave A Reply

Your email address will not be published.