নির্দোষ মানুষকে বরখাস্ত করে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে অভিযুক্ত কে

৫১

সুমন আনোয়ার: ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) একটি প্রকল্পে সেতু ও সংলগ্ন সড়ক নির্মাণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ শেষের আগেই প্রায় ৯ কোটি টাকার পুরো বিল পরিশোধের ঘটনা ঘটেছে। এই ভুয়া বিল পরিশোধের প্রস্তাব উত্থাপন করেন ওই প্রকল্পের ব্যবস্থাপক (পিএম) ও করপোরেশনের এক নির্বাহী প্রকৌশলী। আর ওই প্রস্তাব যাচাই-বাছাই না করেই প্রকল্প পরিচালক, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রধান প্রকৌশলীর স্বাক্ষরে বিল ছাড় হয়েছে।

বিষয়টি কর্র্তৃপক্ষ জানতে পারলে প্রকল্প পরিচালককে (পিডি) প্রথমে সাময়িক বরখাস্ত এবং পরে তদন্ত শেষে তাকে দোষীসাব্যস্ত করে চাকরিচ্যুত (বরখাস্ত) করা হয়। যদিও এ ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী যিনি প্রধান অপরাধী সেই প্রকল্প ব্যবস্থাপক রয়েছেন বহাল তবিয়তে, পেয়েছেন পদোন্নতিও। শুধু তাই নয়, সংশ্লিষ্ট অন্য কর্মকর্তাদের কাছেও এ ব্যাপারে কোনো ব্যাখ্যাও জানতে চাওয়া হয়নি। ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও।

পুরো তদন্ত প্রক্রিয়ায় প্রকল্প ব্যবস্থাপককে ছাড় দেওয়া হয়েছে। আর দোষী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে প্রকল্প পরিচালককে। পুরো বিষয়টি সাজানো বলে মনে করছেন অনেকেই। একই দিনে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জালিয়াতির ওই প্রক্রিয়াটি শেষ করেছেন। কাজের মূল তদারককারী হিসেবে প্রকল্প ব্যবস্থাপককে জবাবদিহিতায় আনার প্রয়োজন হলেও তা করা হয়নি। পাশাপাশি প্রকল্প পরিচালক মূল তদারককারী না হওয়ার পরও তাকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। আর মূল তদারককারী প্রকল্প ব্যবস্থাপক পদোন্নতি পেয়েছেন।

জালিয়াতির এ ঘটনাটি ঘটেছে ডিএসসিসিতে নবসংযুক্ত নাসিরাবাদ, দক্ষিণগাঁও, ডেমরা ও মাণ্ডা এলাকার সড়ক অবকাঠামো ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়ন প্রকল্পে। এ প্রকল্পের আওতায় ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডের লায়নহাটি সড়কের আবেদ মাস্টারের বাড়িসংলগ্ন দেবদোলাই খালের ওপর ৩০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৯ দশমিক ৮ মিটার প্রস্থের সেতু নির্মাণের কার্যাদেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে সেতুতে ওঠানামার জন্য দুই পাশে ৩০ মিটার করে ৬০ মিটার সড়ক নির্মাণকাজও ওই দরপত্রের আওতায় ছিল। কিন্তু কাজ শেষ না হওয়ার আগেই ২০২১ সালে শতভাগ কাজ শেষ দেখিয়ে বিল পরিশোধের প্রস্তাব করেন ওই প্রকল্পের ব্যবস্থাপক ও ডিএসসিসির অঞ্চল-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম। আর কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই না করেই ওই বিল অনুমোদন করেন প্রকল্প পরিচালক ও ডিএসসিসির নির্বাহী প্রকৌশলী তানভীর আহমদ, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী প্রয়াত মুনসী মো. আবুল হাশেম এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) থেকে প্রেষণে দায়িত্বে থাকা তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী রেজাউর রহমান। প্রকৌশল বিভাগের সব শাখা থেকে ফাইল অনুমোদন করায় ঊর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে হিসাব বিভাগ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স ভূঁইয়া অ্যান্ড কোম্পানিকে বিল পরিশোধ করে।

বিল পরিশোধের পর ভুয়া বিলের বিষয়টি কর্র্তৃপক্ষের নজরে আসে। এরপর কর্র্তৃপক্ষ কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই প্রথমে প্রকল্প পরিচালক ও ডিএসসিসির নির্বাহী প্রকৌশলী তানভীর আহমদকে বরখাস্ত করে। অথচ এ ধরনের অপরাধের প্রধান দায় প্রকল্প ব্যবস্থাপকের। কেননা তিনি ওই বিল পরিশোধের প্রস্তাব করেন। কাজ শেষ না হলে ভুয়া বিল প্রস্তাবের দায়ে তার চাকরি হারানোর কথা। অথচ প্রকল্প ব্যবস্থাপক ও অঞ্চল-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী সাইফুল ইসলামকে কোনো কারণ দর্শানোর নোটিসও দেওয়া হয়নি। এমনকি নির্বাহী প্রকৌশলীর অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা অবস্থায় এমন ঘটনার পর পেয়েছেন পদোন্নতিও। অথচ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা (পিপিআর) ২০০৮ এর ৩৯ নম্বর বিধানে এমন অপরাধের জন্য প্রকল্প ব্যবস্থাপককে মূল দায়ী করা হয়েছে। কিন্তু ওই ধারাতে কর্র্তৃপক্ষ শাস্তি দিয়েছে প্রকল্প পরিচালককে। তদন্ত কমিটিও পিপিআরের ওই বিধান উল্লেখ করে প্রকল্প পরিচালককে দায়ী করেছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, প্রকল্প কর্মকর্তা, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রধান প্রকৌশলীর কোনো দায় চিহ্নিত করা হয়নি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) সাবেক মহাপরিচালক একেএম ফজলুল করিম দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিপিআর-২০০৮ এর ৩৯ বিধি অনুযায়ী কাজ শেষ না করে ভুয়া বিল পরিশোধের জন্য প্রধানত দায়ী প্রকল্প কর্মকর্তা। কেননা তিনি এ বিলের প্রস্তাব করেন। এরপর দায় আসে প্রকল্প পরিচালক, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, প্রধান প্রকৌশলী এবং অন্যদের ওপর। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানেরও এখানে বড় দায় রয়েছে; তারা পুরো কাজ শেষ না করে বিল নিল কেন? এমন অপরাধের জন্য প্রকল্প কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। প্রকল্প ব্যবস্থাপককে বাদ দিয়ে প্রকল্প পরিচালককে চাকরিচ্যুত করলে তা আইনত সঠিক হবে না।

তিনি আরও বলেন, পিপিআরের বিধি-১২৭ এবং পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট (পিপিএ)-এর ৬৪ ধারা অনুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে এ ধরনের ছলচাতুরীর অপরাধের দায়ে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কাজ থেকে বরখাস্ত করা অথবা সর্বোচ্চ দুই বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করা যেতে পারে। এখানে কঠিন শাস্তি হচ্ছে, কালো তালিকাভুক্তকরণ; কেননা, এ সময়ে ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের টার্নওভার থাকে না। আর টার্নওভার না থাকলে দুই বছর পর সরকারি দরপত্রে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করতে প্রায় ১০ বছর লেগে যায়। কারণ বেসরকারি কাজের অভিজ্ঞতা সরকারি কাজের ক্ষেত্রে গ্রহণ করা হয় না।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই প্রকল্পের ব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম ২০২১ সালের ৩০ জুন ভুয়া বিল পরিশোধের প্রস্তাব প্রকল্প পরিচালকের কাছে পাঠান। আর তাতে ওইদিনই স্বাক্ষর করেন প্রকল্প পরিচালক, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, প্রধান প্রকৌশলী ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। ভুয়া বিল পরিশোধের তথ্য ফাঁস হলে ২০২১ সালের ৪ আগস্ট প্রকল্প পরিচালক তানভীর আহমদকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এরপর ২০২১ সালের ১৮ নভেম্বর তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, অভিযোগ তদন্তে ২০২২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ডিএসসিসির তৎকালীন অঞ্চল-৭-এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ মাহে আলমকে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তা বদলি হওয়ায় ২০২২ সালের ১৩ জুলাই ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিনকে নতুন তদন্তকারী কর্মকর্তা করা হয়। এই তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেন। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘জুন ক্লোজিংয়ের দোহাই দিয়ে গ্রিল ও অ্যাপ্রোচ রোডের কাজ অসম্পূর্ণ রেখে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সম্পূর্ণ বিল পরিশোধের সুপারিশ করায় পিপিআর-২০০৮ এর ৩৯ বিধান লঙ্ঘিত হয়েছে। বিলের অর্থ আগেই উত্তোলন করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণভাবে নৈতিকতাবিরোধী ও জরিমানাযোগ্য।’

চাকরিচ্যুতকরণের অফিস আদেশে বলা হয়, ‘ওই কর্মচারীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হওয়ায় ঢাকা সিটি করপোরেশন কর্মচারী চাকরি বিধিমালা ২০১৯ বিধি ৫০(১)(খ)(ঙ) অনুযায়ী তাকে গুরুদণ্ড আরোপ করা হলো এবং উক্ত কর্মচারীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলো।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ভুয়া বিলের প্রস্তাবক প্রকল্প ব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম প্রথমে দাবি করেন ওই প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক ছিলেন অন্য একজন প্রকৌশলী। তাহলে বিল প্রস্তাবের ফাইলে তার স্বাক্ষর রয়েছে কেন এমন প্রশ্নের জবাবে মোবাইল ফোনে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, ওই সময়ে দায়িত্বে ছিলাম বলে করেছি।’ ভুয়া বিলের প্রস্তাব কেন করা হলো এমন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ব্যস্ততার কথা বলে মোবাইল ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরে আবার কল করলে বলেন, ‘ভাই, আমি সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে পারি না। আপনি কর্র্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলুন।’

ডিএসসিসির ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও করপোরেশনের সচিব আকরামুজ্জামানের কাছে এ প্রসঙ্গে জানতে তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নম্বরে একাধিকবার কল করলেও রিসিভ করেননি। এরপর কল করার কারণ জানিয়ে বার্তা (এসএমএস) পাঠানো হলেও কোনো সাড়া মেলেনি। পরে ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা ও মুখপাত্র মো. আবু নাছেরের মাধ্যমে আকরামুজ্জামানের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করা হলেও তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। পরে গণমাধ্যম মুখপাত্র হিসেবে বিষয়টি নিয়ে আবু নাছেরের কাছে ডিএসসিসির ভাষ্য জানতে চাইলে তিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অবগত নন বলে জানান।

অন্যদিকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স ভূঁইয়া অ্যান্ড কোম্পানির স্বত্বাধিকারী নুরু ভূঁইয়ার দাবি, তারা কাজ ছাড়া কোনো বিল নেননি। কিন্তু ডিএসসিসির তদন্তে কাজ শেষ না করেই বিল নেওয়ার প্রমাণ মেলার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আপনাকে এত কিছু বলতে হবে কেন? আপনি সিটি করপোরেশনের সঙ্গে কথা বলুন।’ এরপর বিরক্তি প্রকাশ করে মোবাইল ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা গ্রহনের দাবী।

100% LikesVS
0% Dislikes
Leave A Reply

Your email address will not be published.