মাদারীপুরে আলোচিত চিত্র নায়িকা বনশ্রীর আশ্রয় এখন আশ্রয়ণ প্রকল্পে ।

৩২

 

সাইফুল ইসলাম,নিজস্ব প্রতিনিধি।এত অভাবে জীবন কাটাতে হবে কোনোদিন ভাবিনি। চাল থাকে তো নুন থাকে না অবস্থা। এভাবেই জীবনটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। বাকি দিনগুলো কীভাবে কাটবে বুঝতে পারছি না।

তারপরও এই আশ্রয়ণের লোকদের কাপড় সেলাই করে কোনোমতে সংসার চালাচ্ছি। কখনো দুঃখ কি এটা বুঝতে পারিনি। এমন সময় জীবনে অভাব-অনটন এসে চাপবে এটা বুঝতে পারিনি। আমি চলচ্চিত্রে কাজ করেছি, সবাই আমাকে চেনে, যে কারণে ভিক্ষা করার কথাও চিন্তা করতে পারি না।

এ কথাগুলো বলছিলেন এক সময়ের আলোচিত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী বনশ্রী।এই অভিনেত্রীর বাড়ি মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার মাদবরেরচর ইউনিয়নের শিকদার কান্দি গ্রামে। তার পুরো নাম সাহিনা শিকদার বনশ্রী।

বাবা মজনু শিকদার ওরফে মজিবুর রহমান শিকদার ও মা সবুরজান (রিনা)। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে বনশ্রীই বড়। বনশ্রীর বাবা ঠিকাদারি করার কারণে সাত বছর বয়সেই শিবচর থেকে চলে যান রাজধানীতে।

বনশ্রী চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন ১৯৯৪ সাল থেকে। এরই মধ্যে তিনি একাধিক ছবিতে কাজ করেছেন। কিন্তু বর্তমানে কোনো কাজের ডাক পাচ্ছেন না তিনি। বলতে গেলে অর্থকষ্ট ও অর্ধাহারেই দিন কাটছে তার।
‘সোহরাব রুস্তম’ সিনেমার মধ্য দিয়ে ১৯৯৪ সালে চলচ্চিত্রে পা রাখেন নায়িকা বনশ্রী।

মমতাজ আলী পরিচালিত এই সিনেমায় বনশ্রীর নায়ক ছিলেন ইলিয়াস কাঞ্চন। একই বছর মুক্তি পায় এই নায়িকার দ্বিতীয় সিনেমা ‘মহা ভূমিকম্প’। সুভাষ ঘোষ পরিচালিত এই সিনেমায় বনশ্রী দুই নায়ক মান্না ও আমিন খানের বিপরীতে অভিনয় করেন। তিনি অভিনয় করেছেন আরও অনেক নায়কের বিপরীতে। ভাবতেই অবাক লাগে এক সময় ডালিউডের পর্দা কাপানো এই নায়িকা বর্তমানে বাস করেন সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে।

তিনি জানান, ছোটবেলা থেকেই তিনি সংস্কৃতি চর্চার প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন ফলে একসময় উদীচী গণ সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি ভালো গান করতেন। এরপর অভিনয় শেখার জন্য যোগ দেন সুবচন নাট্য সংসদে। বিটিভির স্পন্দন অনুষ্ঠানে নিয়মিত আবৃত্তি করেছেন।

পরে তিনি যুক্ত হন সিনেমায়। প্রায় দশটি সিনেমায় কাজ করেছেন তিনি। যদিও এর মধ্যে তিনটি ছবি আলোর মুখ দেখেনি। এর মধ্যে সোহরাব-রুস্তম চলচ্চিত্রে ইলিয়াস কাঞ্চনের বিপরীতে অভিনয়ের মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্রে তার অভিষেক ঘটে।

এরপর নেশা, মহা ভূমিকম্প, প্রেম বিসর্জন, ভাগ্যের পরিহাস ইত্যাদি চলচ্চিত্রে একনাগাড়ে অভিনয় করেছেন তিনি। মান্না ও রুবেলের মতো নায়কের সঙ্গে অভিনয় করেছেন তিনি। একটি ঝামেলায় পড়ে বাদ দিতে হয়েছে চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্র ছেড়ে দেওয়ার পর আর্থিক অনটনের কারণে কিছুদিন তিনি ঢাকার শাহবাগের ফুল মার্কেটে ফুলের ব্যবসা করেছেন। বিভিন্ন বাসে হকারি করেছেন, বিক্রি করেছেন নামাজ শিক্ষার বই।

মহামারী করোনার পরে চলে আসেন নিজ উপজেলা শিবচরে। বর্তমানে বসবাস করছেন শিবচর উপজেলার মাদবরের চর ইউনিয়নের আশ্রয়ন প্রকল্পের একটি ঘরে। সেখানে তিনি দর্জি কাজ করে তার সংসার চালাচ্ছেন।

তার সাথে কথা বলার ফাঁকে তিনি বলেন, তার দুই ছেলে-মেয়ে। বড় মেয়েটি কিডনাপ হয়েছিল যখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। তখন তিনি মেয়ের কোনো খোঁজ না পেয়ে একেবারে ভেঙে পড়েন। কিডন্যাপ করে সঙ্গিতার মালিক সেলিম খান তার মেয়েকে মডেল বানিয়েছেন। তাকে আর ফেরত দেয়নি। আমি মেয়েকে ফেরত পাওয়ার জন্য থানা পুলিশের আশ্রয় নিয়েও মেয়েকে আর ফেরত পাইনি।

বনশ্রী দুর্দিনে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে শেখ হাসিনার সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে তার হাতে তুলে দেওয়া হয় ২০ লাখ টাকা। এতেও অভাব ঘোচেনি বনশ্রীর। স্থায়ী ঘর না থাকায় স্বস্তিতে ছিলেন না তিনি। অবশেষে তার ঠাই হয় আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে।

বনশ্রী বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে ২০ লাখ টাকা দিয়েছেন। সেই টাকা আমি ব্যাংকে রেখেছি। আগে সেই টাকার লাভের অংশ দিয়ে চলতাম। সেই টাকায় ২১ হাজার ৪শ টাকা লাভ পেতাম। এই টাকা দিয়ে ঢাকায় একটি ফ্লাটে সাবলেট থাকতাম। পরে আনুমানিক ৪ বছর হবে সেই লাভের টাকা থেকে ৪ হাজার ২০ টাকা ব্যাংক কেটে নিয়ে যায়। বর্তমানে প্রতিমাসে ১৭ হাজার ২শ টাকার মতো ওখান থেকে লাভ পাই। কিন্তু সেই টাকায় নিজের ওষুধ কিনে সংসারের কেনাকাটা করে ছেলের পড়ালেখার খরচ চালানো যাচ্ছে না। পরে আমি গ্রামে চলে আসি। এখানে এসে একটি টিনের ঘর ভাড়া নেই। অনেকে আমাকে ঘর ভাড়া দিতে চায়নি। পরে টেলিভিশনে দেখি প্রধানমন্ত্রী মানুষকে ঘর দিচ্ছেন। তখন আমি চিন্তা করলাম আমি ওখানে চলে যাব। এখানে যেই ঘর, ঠিক ছোটখাটো একটি ফ্লাটের মতো। এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর আমার কাছে অনেক ভালো লাগে। কারণ এর থেকেও আমি অনেক খারাপ ঘরে থেকেছি। আমার মনে হয়কি জানেন? এখন আমি ভালো একটি জায়গায় অবস্থান করছি।

সিনেমার মানুষ তাই সিনেমায় আর কাজ করার ইচ্ছে থাকলেও তা সম্ভব নয় বলে আশা ত্যাগ করেন বনশ্রী। তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে আছি। এটি আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। আমি আর এখন নায়িকা নেই। আমার মেয়েটি হারিয়ে গেছে। কোথায় আছে জানিনা আমি। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে এই বেদে পল্লিতে বেঁচে আছি শেখ হাসিনার দয়ায়।

তিনি আরও বলেন, এখন কষ্ট করে দিন যাচ্ছে। মাঝে মাঝে রাজনৈতিক মিটিংয়ে যাই। ছেলেটা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে ওকে সময় দেই। আমি ঘরে বসেই সেলাইয়ের কাজ করি।

চার দশকের মতো কাজ করলেও কেন কোনো সঞ্চয় করেননি জানতে চাইলে বনশ্রী বলেন, আমরা কি আর টাকার জন্য কাজ করেছি? নেশা থেকেই কাজ করতাম। যেদিন শুটিং থাকত না, সেদিনও এফডিসিতে গিয়ে আড্ডা দিয়ে আসতাম। তাছাড়া একজন সহশিল্পী কত টাকা পায়? টাকা তো পায় হিরো-হিরোইনরা। তারা দুই লাখ টাকা পেলে আমরা পেতাম দুই হাজার, ছবির পরিচালকও ঠিক মতো টাকা পায় না । শুধু আমাদের সময়ই না, এখন যারা সহশিল্পী হিসেবে কাজ করছে তাদের কতজন স্বচ্ছল? এটা আসলে বলে লাভ নেই। টাকা যা পেয়েছি, তখন পোলাও কোরমা খেয়েছি, কিন্তু জমানোর মতো টাকা কখনোই পাইনি।

লামিয়া নামের আরেক নারী বলেন, যাইহোক এনার ছবি অনেক দেখছি আজকে তারে আমরা বাস্তবে দেখতে পারতেছি। তার সঙ্গে কথা বলতে পারতেছি। তার জীবনের এত দুর্দশা হবে আমরা কখনোই ভাবতে পারিনি।

শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাজিবুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশের একজন মানুষ ও ভূমিহীন ও গৃহহীন থাকবে না। প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় শিবচর উপজেলার প্রত্যকটি ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষকে পুনর্বাসিত করেছি। সেই প্রকল্পের আওতায় ঘর পেয়েছেন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী বনশ্রী। তিনি ভূমিহীন ক্যাটাগরিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের আশ্রয়ণ প্রকল্পে একটি ঘর পেয়েছেন।

100% LikesVS
0% Dislikes
Leave A Reply

Your email address will not be published.