ইউক্রেন যুদ্ধ ও মোদির কিয়েভ মিশন

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেদিন মস্কোতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তাঁর বিতর্কিত বৈঠকটি করছিলেন, কাকতালীয়ভাবে ওই দিন ওয়াশিংটনে ন্যাটোর শীর্ষ সম্মেলন চলছিল। এর এক মাসের কিছু বেশি সময় পর (চলতি আগস্টের শেষের দিকে) মোদি ইউক্রেন সফর করতে যাচ্ছেন।

কিয়েভের একটি শিশু হাসপাতালে এবং ইউক্রেনজুড়ে যেদিন রাশিয়া বিমান হামলা চালিয়ে কমপক্ষে ৪২ জন বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছিল, সেদিন সংবাদমাধ্যমে পুতিনের সঙ্গে মোদির কোলাকুলির ছবি সম্প্রচারিত হচ্ছিল। সেই ছবি ব্যাপক ক্ষোভ উসকে দিয়েছিল। ওই দিন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছিলেন, মস্কোতে বিশ্বের সবচেয়ে নিকৃষ্ট রক্তপিপাসু অপরাধীকে এমন একটি দিনে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের নেতার এভাবে আলিঙ্গন করাটা শান্তিপ্রচেষ্টার ওপরে একটি ধ্বংসাত্মক আঘাত।

তাহলে মোদির এই আচরণের ব্যাখ্যা কী হতে পারে? ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ভারত সতর্ক পথে হাঁটছে। দুই বছরের বেশি সময় ধরে ভারত রাশিয়ার সঙ্গে তার দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক এবং জাতিসংঘ সনদের প্রতি সমর্থনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ক্রেমলিনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার বিষয়ে ভারতের অনীহার কারণ সহজেই বোঝা যায়। ভারত বাইরে থেকে যত অস্ত্র কিনেছে, তার ৪০ শতাংশের বেশি কিনেছে রাশিয়ার কাছ থেকে।

তবে এটিও নিশ্চিত করে বলা যায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাশিয়া থেকে ভারতের অস্ত্র কেনা অনেকটা কমে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইসরায়েল এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশ থেকে বেশি অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কিনছে দেশটি। অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম খাতে ভারতের ক্ষেত্রে অতীতের জের তার বর্তমানের ওপর অনেক বেশি প্রভাব ধরে রেখেছে। কেননা ভারতের ৮৬ শতাংশ সামরিক সরঞ্জামই রাশিয়ান ‘বংশোদ্ভূত’ এবং সেগুলো চালু রাখতে হলে রাশিয়ার খুচরা যন্ত্রাংশ লাগবেই। 

এদিকে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের জ্বালানি সম্পর্ক গভীর হয়েছে। ২০২১-২২ সালে ভারত যেখানে রাশিয়া থেকে ২৪০ কোটি ডলারের অপরিশোধিত তেল আমদানি করেছিল, বড় ধরনের মূল্য ছাড় পেয়ে সেখানে ২০২৩-২৪ সালে তারা রাশিয়া থেকে আমদানি করেছে ৪ হাজার ৬৫০ কোটি ডলারের তেল। মূলত মস্কোর ওপর পশ্চিমাদের অবরোধের সুবাদেই রাশিয়া ভারতের তেল ও গ্যাসের প্রধান সরবরাহকারী হয়ে উঠেছে। 

পশ্চিমারা এখন স্বীকার করছে, ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে এই বিপুল পরিমাণ জ্বালানি কেনার কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানির দাম বৃদ্ধি ঠেকানো গেছে। এ কারণে পশ্চিমারা ভারতের এই জ্বালানি কেনাকে নীরবে ক্ষমার চোখে দেখে আসছে।

এই সবকিছুর পরিপ্রেক্ষিতে ভারত এখন পর্যন্ত ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য রাশিয়ার সমালোচনা থেকে বিরত থেকেছে। ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘে অনুষ্ঠিত কয়েক দফা ভোটাভুটিতে ভোটদান থেকেও বিরত থেকেছে। 

 মস্কোতে পুতিনের সঙ্গে মোদির বৈঠকের পর যে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছিল তা থেকে বোঝা যায়, রাশিয়া ইউক্রেনের দখলকৃত অংশকে নিজের অংশ বলে যে দাবি করে আসছে, তাতে ভারত সায় দিচ্ছে। একই সঙ্গে ভারত রাশিয়ার এই আগ্রাসনমূলক অভিযানকে স্বীকৃতি না দেওয়ার ব্যাপারেও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। মস্কোতে পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের সময় মোদি স্পষ্ট করেই বলেছেন, এই যুদ্ধের সমাধান যুদ্ধক্ষেত্রে পাওয়া যাবে না। 

যদিও যুক্তরাষ্ট্র সরকার রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের এই ভারসাম্যমূলক সম্পর্ককে মেনে নিয়েছে, তারপরও মোদির মস্কো সফরকে তারা ‘দুঃখজনক’ বলে আখ্যায়িত করেছে।  এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এই বার্তা দিচ্ছে যে চীনের আধিপত্য মোকাবিলার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে একটি অপরিহার্য অংশীদার হিসেবে গণ্য করলেও রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা ওয়াশিংটন ও দিল্লির বিপক্ষীয় সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি করতে পারে। 

ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানে ভারতের অগ্রণী ভূমিকা রাখা ওয়াশিংটনের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক বাড়ানোর ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে। এ ক্ষেত্রে মোদি তার কিয়েভ সফরকে কাজে লাগাতে পারেন। মোদির মস্কো সফর যেমন ওয়াশিংটনের বিরক্তি উৎপাদন করেছিল, তেমনি তাঁর ইউক্রেন সফর মস্কোকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানাতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। তারপরও মোদির ইউক্রেন সফর অত্যন্ত জরুরি। এই সফরের মধ্য দিয়েই ইউক্রেন যুদ্ধ ইস্যুতে ভারতের মধ্যস্থতা করার সক্ষমতা বৈশ্বিক মঞ্চে প্রদর্শিত হতে পারে।