রাসেল আদিত্য,নারায়ণগঞ্জ :
দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস ওঠা সাধারণ মানুষ বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিজেদের মানিয়ে নেবার সংগ্রামে লিপ্ত পুরো বাংলাদেশ জুড়ে।নারায়ণগঞ্জের মানুষও একই চেষ্টায় মত্ত থাকতে চাইলেও পেরে উঠছেন না।গত মাসাধিকাল সময় ধরে তীব্র গ্যাস সংকট স্থানীয় সাধারণ মানুষের জন্য মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে চেপে বসেছে।নারায়ণগঞ্জে গ্যাস সংকট পুরনো সমস্যা।কিন্তু আগে কখনোই এই সমস্যা এতোটা প্রকট আকার ধারণ করেনি।দিনে না পেলেও রাতে
মানুষ গ্যাস পেয়েছে।রাত জেগে জেলার গৃহিণীরা পরের দিনের জন্য রান্না করে রাখতে পারতেন।
কিন্তু এবার গত দেড়মাস ধরে দিন-রাত কোন সময়ই গ্যাস পাচ্ছেন না স্থানীয় মানুষ।আয় না বাড়লেও ব্যয় বেড়েছে,তাই বিকল্প জ্বালানীর সংস্থান করার মতো সঙ্গতি নেই বেশির ভাগ পরিবারের।তারউপর দুঃসময়ের সুযোগ নেওয়া মনোবৃত্তির ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন অজুহাতে সব ধরনের জ্বালানীর দাম বৃদ্ধি করায় বিকল্প জ্বালানীর মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা আরও দুঃসাধ্য হয়ে গেছে সাধারণ মানুষের পক্ষে।স্থানীয় বাজারে সিলিন্ডার প্রতি এলপি গ্যাসের দাম বেড়েছে দুইশত টাকা,আড়াইশ টাকা মূল্যের ষ্টোভ বিক্রি হচ্ছে সাড়ে তিনশত টাকায়।এমতাবস্থায় তীব্র ক্ষোভে ফুঁসছেন জেলার সাধারণ মানুষ।যদিও গ্যাসের সংকট জেলার সর্বত্র একই রকম নয়।রুপগন্জ, সোনারগাঁও উপজেলায় সংকট তেমন তীব্র না হলেও সদর,ফতুল্লা,বন্দর উপজেলা ও সিটি কর্পোরেশন এলাকায় গ্যাস সংকট গত মাসাধিকাল সময় ধরে প্রকট আকার ধারণ করেছে।সংকটের দীর্ঘসূত্রিতার শিকার জেলার বড় একটি অংশের লক্ষ লক্ষ মানুষ।গত ৩১শে আগষ্ট নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ
আলহাজ্ব একেএম শামীম ওসমান সাধারণ মানুষের ভোগান্তি লাঘবে ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহনের আহবান জানিয়ে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখেছেন।বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠন প্রতিদিনই শহরে তিতাস অফিস ঘেরাও, মানববন্ধন,বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশ করছেন।কিন্তু কিছুতেই পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন বা উন্নতি হচ্ছেনা।বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ায় এনিয়ে ফলাও করে সংবাদ পরিবেশিত হচ্ছে।শহরের রাজপথে দিনভর বিভিন্ন কর্মসূচী পালিত হচ্ছে।সেখানে বাড়ছে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ।এই অবস্থা চলতে থাকলে নারায়ণগঞ্জে সাধারণ মানুষের ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটার আশংকা করছেন বিজ্ঞজনদের অনেকে।
জেলার সদর,ফতুল্লা,বন্দর,সিদ্ধিরগন্জ থানাধীন এলাকা সরেজমিনে ঘুরে সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে এই প্রতিবেদক সর্বত্রই বিপর্যস্ত মানুষের তীব্র ক্ষোভের প্রকাশ দেখতে পেয়েছেন।ফতুল্লা থানাধীন ১ নং বাবুরাইল এলাকার বাসিন্দা গৃহিণী মেহনাজ(৩৫) এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানান,গত এক মাসের বেশি সময় ধরে তাঁদের পরিবার কোনদিনই তিন বেলা খেতে পারেননি।জ্বালানীর অভাবে রান্না করা সম্ভব হচ্ছেনা।সকালের নাস্তা বাদ দিয়ে দিয়েছেন তাঁরা,বাচ্চাদের সকালে ঘুম থেকে আর ডেকে তোলেননা উল্টো ওঁরা যেনো দেরিতে ঘুম থেকে ওঠে সেই কামনা করেন।মেহনাজ আরও জানান, প্রতিবেশীর বাসার মাটির চুলায় তাঁদের মতো আরও তিন পরিবারের রান্নার ব্যবস্থা হয়।তাই সিরিয়াল পেতে তারপর রান্না শেষ করতে সন্ধ্যা গড়িয়ে যায় বেশিরভাগ দিন।
সদর থানাধীন নাসিক ১৮ নং ওয়ার্ডের আল আমিন নগরের গৃহিণী কেয়া ইসলাম বলেন, “আপনেরা একটু ভালা কইরা লেখেন,আমরা ঘরে খাওন(খাবার) থাকতেও না খাইয়া থাকি,যেই ট্যাকা ইনকাম হয় তাতে সিলিন্ডার বা লাকড়ি দিয়া রান্না করার ক্ষমতা গরিবের নাই”।মাসদাইর এলাকার বাসিন্দা গার্মেন্টস শ্রমিক মোঃ সুমন বলেন,মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। আমরা গ্যাস পাইনা অথচ মাস শেষে ঠিকই বিল গুনতে হচ্ছে।দিনে কমপক্ষে ১২ ঘন্টা ডিউটি করে বাসায় ফিরে দেখতে হয় রান্না হয়নি।ঘরের মা-বোন-স্ত্রীরা বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে টাকার বিনিময়েও সময়মতো রান্না করে আনতে পারেন না।সমস্যা দুই-চারদিন হলে মেনে নেওয়া যায় কিন্তু দিনের পর দিন কিভাবে সম্ভব?
একই রকম প্রতিক্রিয়া সিটি কর্পোরেশন, বন্দর, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা এলাকার বাসিন্দাদেরও।যদিও তিতাসগ্যাস কর্তৃপক্ষ মিডিয়াকে প্রতিদিনই জানাচ্ছেন,তাঁরা প্রাণপন চেষ্টা করে চলেছেন।গত কয়েকদিনে হাজার হাজার অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।তবুও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না।এই সংকটের জন্য সরবরাহের ঘাটতিকে দায়ী করে তাঁরা জানান,সরবরাহ বৃদ্ধি না পেলে তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয় কিছু করা।এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী শাকির আহমেদ দৈনিক সাহসীকন্ঠকে জানান, বর্তমানে আমাদের যে পরিমান গ্যাসের চাহিদা সে পরিমান গ্যাসের সাপ্লাই আমরা দিতে পারছি না। নারায়ণগঞ্জে আমাদের যে চাহিদা তার অর্ধেকেও বর্তমানে সরবরাহ নেই। বরং দিন দিন সরবরাহের পরিমাণ কমছে। যে কারণে একের পর এক বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস থাকছে না। গ্যাস সঙ্কট নিরসনের দাবিতে স্থানীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমান তার প্যাডে আমাদের কাছে চিঠি দিয়েছেন।আমাদের এই সংকটটা যে শুধু নারায়ণগঞ্জে তা কিন্তু নয়। এটা সারা দেশেই চলছে। আমি যে এলাকায় বাস করি, সেখানেও গ্যাস নেই। এই সঙ্কটের অন্যতম কারণ রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ। ওই যুদ্ধের কারণে জ্বালানির দাম যেমন বেড়েছে তেমনি আমদানিকৃত জ্বালানিও চাহিদা মোতাবেক পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধন করেছেন। যদি এটা চালু হয়ে যায় তাহলে গ্যাস চালিত যে পাওয়ার প্লান্ট আছে সেগুলোর ওপর চাপ কমবে। এর আগেও বেশ কিছু গ্যাস ডিজেল চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাইরে পাওয়ার প্লান্ট চালু হয়েছে। এতে আমরা আশা করছি গ্যাস ডিজেলের ওপর চাপ কমবে। চলতি মাসের শেষের দিকে সরকারের আমদানি করা জ্বালানি পাইপলাইনে ঢুকবে বলে জানতে পেরেছি। তখন গ্যাসের সরবরাহ আরো বাড়বে।
দুর্ভোগে পড়া নারায়ণগঞ্জবাসীকে ধৈর্য ধরার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন আমরা সংকট নিরসনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে চলেছি।
যদিও নাগরিক কমিটির নেতা এডভোকেট মাহবুবুর রহমান মাসুম তিতাসকে আপাদমস্তক দূর্নীতিতে নিমজ্জিত সংস্থা বলে অভিযুক্ত করে।
তাঁদের এই বক্তব্য নাকচ করে দিয়ে বলেন,গ্যাস নিয়ে নারায়ণগন্জ সিটি ও আশেপাশের লাখ লাখ সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে ফাজলামো শুরু করেছে তিতাস।তিনি অভিযোগ করে বলেন রাঘব বোয়ালদের বাসা ও মহল্লায় গিয়ে দেখুন সেখানে সরবরাহ ঠিকই আছে।উল্লেখ্য, গত ১২ই সেপ্টেম্বর আমরা নারায়ণগঞ্জবাসীর ব্যানারে তিতাস ঘেরাও কর্মসূচীতে বক্তারা একই রকম কথা বলেছিলেন।তাঁরা সরাসরি সিটি মেয়রের বাসা ও সংলগ্ন এলাকায় গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক থাকার কথা উল্লেখ করে বলেন,যদি মেয়র এর ঘরে চুলা জ্বলে তবে আমাদের ঘরেও জ্বলতে হবে।সেই বক্তব্যের একটি ভাইরাল ভিডিও জেলায় ব্যাপক আলোচিত হয়।