প্রথাগত মানুষ

১২২

লেখক: আনোয়ার হোসেন বাদল।

একবার রাজগঞ্জের নুরু স্যার বলেছিলেন
“আমার ছাত্রদের মধ্যে তুমিই যা এট্টু মানু অইলা,
তা বাপধন যারা ল্যাহাপড়া ছাইর্রা দিয়
হারা বছর কি সব কি কাম কাইজ হরলে টরলে
হ্যারা তো দেহি টাহাইদ্যা এ্যাক্বালে লাল
হইর্রা হালাইতে আছে
তুমি ল্যাহাপড়া জানা মানু অইয়াও হ্যাগো নাহান
কিছু হরতে পারলা না ক্যা?”

কিছু করতে যে কেন পারিনি
নুরু স্যারকে বললে হয়তো তিনি অনেক কষ্ট পেতেন,
আমার অযোগ্যতার কারন যে কী কী
তাও জানাতে পারিনি

স্যারকে কী জন্যে যে কুড়িয়ে পাওয়া মানেরদ্দির টাকাটা ফেরৎ দিয়েছিলামতা

কি কাউকে বলার বিষয়?

ছেছরা স্মাগলার মানেররদ্দি এখন দেশের দশ জনের একজন,
তার গাড়ীতে দেশের পতাকা পতপত করে ওড়ে
তাঁর হাতে কোটি কোটি টাকার বিলি বন্টন
লেগে থাকলে লাল নীল আমরাও করতাম স্যার।

ছাপরা ঘরে আষাঢ়ের পানিতে সয়লব
বৃষ্টি হলেই বাথরুমের দুর্গন্ধ,
কাদাময় ঘর, পানিবন্দী জীবন
আমার ভালোবাসা
কথায় কথায় খোঁটা দিয়া কয়
“একখানা ভালো ঘরও বানাইতে পারলে না।”

তারে আমি কেমনে বুজাই
দিলের ঘরের পাগল আমি,
মনের ঘরে বাস
আমি তো কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন কোন মানুষ নই
আমি দালানঘর চাইইনি, চেয়েছিলাম একটি বাতিঘর
সমাজতান্ত্রিক ক’টি ছেলে মেয়ে আর একজন খাঁটি দেশজ নারী
আহামরি কোন সন্যাসী কিম্বা বিপ্লবী আমি নই
তাই প্রথমোক্ত দুটি’র কথা বাদ দিলেও
শেষোক্তজন ঠিকই পেয়েছিলাম।

যোগ্যতার মাপকাঠিতে নিদেন পক্ষে একটা
ছাদযুক্ত বাড়ি তো থাকতেই হয়
নইলে কি আর মানুষের মধ্যে কেউ গন্য করে?
নুরু স্যারই তো বলেছিলেন
“লেখাপড়া করে যে,
গাড়ী বাড়ি করে সে”
আমি সেখানে আজীবন ফেলমারা এক
বাউণ্ডুলে।

তবুও এই ছন্নছাড়ার পথ তো আটকে থাকেনি
তাকে আর ওকথা শুনিও না।
নিজগৃহে যার একজীবনের পরবাস,
একা একা স্বমোহনে কেটে যায় যার নীলকণ্ঠী যৌবন
তাকে আর যাই বলা যাক
মৌলিক, কাণ্ডজ্ঞানী বা কাতারবন্দী মানুষ তো বলাই যায় না।

নইলে মোকসেদ মাস্টার তো বলেইছিলেন

” ও ব্যাডা মুন্সির পো, এক এগারোর পর দ্যাশ তো এ্যাহোন মিলিটারীর হাতে
তুমিও তো একদিন মিলিটারী আছিলা। হ্যাগো লগে লাইগ্যা থাহো
টুপাইস কামাইতেও পারবা,
মানুষও অইতে পারবা।”

লেগে থাকা যে কি জিনিস জীবনে তাই তো শিখলাম না
তারপর তো মানুষ হওয়া?
কী করে শিখবো?
একাত্তরে বাপজান বলেছিলেন
“নুররা ম্যাট্টিক পাশ হরেছে তয় আক্কেল পাশ হরে নাই”
আমারও বোধ হয় আক্বেল পাশটা বাকীই ছিলো
একজীবন যার ভরা গাঙে
সাঁতার কেটে যায়,
তার কি আক্কেল থাকে?
যে মানুষ চলমান পালতোলা ছৈয়াল
নায়ের মাঝি হিসেবে নিজেকে দ্যাখে,
তার কি আক্কেল থাকে?
যার আক্কেলই নেই
তার আবার লেগে থাকা!

ছদু পাগলার আখড়ায় সে বছর
এই ব্যাক্কলের কেটে গেলো পাঁচ দিন,
যাত্রাদলের অধিকারী লতিফ মাঝি এসে বললেন
“এ্যাই ব্যাক্কল এইহানে থাইক্যা কি
হরবি?
যাত্রায় অভিনয় হরবি? ”

যাত্রাদলে খেয়ে গেলো যার জীবন
পূর্নিমায় বান ডাকে যার বুকের খরায়
আকণ্ঠ মহুয়া গিলে গিলে
পাপমোচন হয়েছে বলে তৃপ্ত হয় যে
তাকে যে যাই বলুক
তোমরা তাকে প্রথাগত কোন মানুষ বলো না।

নুরু স্যার চলে গেলেন,
মোকসেদ মাষ্টার নেই
বাপজানও অনন্ত ঘুমে
সবাই-ই একদিন চলে যায়,
শরতের শান্ত পায়রার মতো
একদিন থেমে যায় সব কোলাহল
শুধু মানুষ হবার গল্পটা থামবে না।

ইদানীং মানুষ দেখতে পাশের বাড়ির দিকে হা করে তাকিয়ে থাকি
মানেরদ্দির সদ্য নির্মিত সাততলা বাড়িটির দিকে।
মাদক, ধর্ষণ,অস্ত্র, আরও কি কি মামলায় অনেকদিন জেল টেল খাঁটার পর
হঠাৎ কি করে তিনি একদিন মানুষ হয়ে গেলেন
এখন তাঁর চারপাশে কতো মানুষ! একের পর এক বাড়ি
নতুন নতুন মডেলের গাড়ি
এই মানুষ হতে পারলে যা যা হয় আর কি।

আমি যদিও মানুষ ছিলাম না
এবং হতেও পারিনি
তাই ওসব চাইওনি
চেয়েছিলাম শুধুমাত্র একটি বাতিঘর,
প্রলেতারিয়েত ক’টি ছেলে মেয়ে আর
দেশজ একজন মৌলিক নারী
দেশজ নারী তো পেয়েইছিলাম
আর ছেলে মেয়েও
কিন্তু তারাও তো মানুষ হতে চায়
মানুষকে প্রথাগত হতে হয় বৈকি।

-চৌরাস্তা, পটুয়াখালী।

ছবি: ইঞ্জিনিয়ার আরিফ বিশ্বাস।

100% LikesVS
0% Dislikes
Leave A Reply

Your email address will not be published.