মোঃ রফিক ভূঁইয়া খোকা,বিভাগীয় প্রধান,ময়মনসিংহঃ জাতীসংঘ শিশু অধিকার সনদ ১৯৮৯, জাতীয় শিশু নীতি ২০১১ ও শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সী প্রতিটি মানব সন্তান শিশু হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। সে হিসাবে বিশ্ব জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশই শিশু। পথেই যেসকল শিশুর জন্ম, বেড়ে ওঠা, রাত্রী যাপন, কর্মের সংস্থান, জীবিকা অন্বেষণ তথা সামগ্রীক জীবন যাপন তারাই পথশিশু হিসেবে আমাদের কাছে পরিচিত। তবে নদীর পাড়, খোলা আকাশ, পার্ক, ফুটপাথ, রেলস্টেশন, ফেরিঘাট, লঞ্চ-টার্মিনাল, বাসস্টেশন ইত্যাদি স্থানে দিনাতিপাত করা শিশুগুলোও এ সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের অন্তর্ভুক্ত।
বাংলাদেশ আয়তনে নিউইয়র্ক শহরের মত হলেও অধিক ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশে মোট জনসংখ্যার মধ্যে ৬ কোটিরও বেশি শিশু। যদিও পথশিশুদের নিয়ে আমাদের দেশে কোন সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই তবুও জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অঙ্গসংগঠন ইউনিসেফ-এর তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা ১০ লাখের বেশি।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর মধ্যে রাজধানী ঢাকাতেই ছয় লাখ পথশিশু আছে। পথশিশু বাংলাদেশের ভাসমান জনগোষ্টীরই একাংশ। প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় আড়াই মিলিয়ন শিশু জন্মগ্রহণ করে। এদের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশ বাস করে দরিদ্র সীমার (যাদের নিজের বাড়ী-ঘর নেই) নিচে। মূলত এর একটি বিরাট অংশই পথশিশু।
বাংলাদেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও পত্র-পত্রিকা খুললেই দেখা যায় সমস্ত দেশজুড়ে সর্বত্র উন্নয়নের মহাজোয়ার বয়ে চলছে। স্বাধীনতা লাভের পর সেই ৭১ থেকেই আজ অবধি প্রত্যেক সরকারের আমলেই বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড ও প্রকল্পের কথা শুনা গেলেও সেসবের যথার্থ বাস্তবায়ন হয়নি। হলেও হয়ত দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে ওপরে উল্লেখিত একটি বিরাট অংশ সুবিধাবঞ্চিত পথশিশু অর্থাৎ ছিন্নমূল ভাসমান জনগোষ্ঠী বলে এরূপ কিছুর অস্তিত্ব থাকার কথা নয়। তাছাড়া দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা ও NGO- দের এ নিয়ে উন্নয়ন ও কর্মতৎপরতার কথা তো বলতেই হয় না।
তথাপি আজও এ দেশের পথশিশুদের ভাগ্যে মাথাগুঁজার মত একটু জায়গা-আশ্রয় জুটল না। শেষ হলো না তাদের জীবন-জীবিকার বিড়ম্বনা। শিশুশ্রম ও অল্পতেই শিশু নির্যাতন তো পত্রিকা খুললে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম Facebook অন করলেই দেখা যায়। পথশিশু, শিশুশ্রম, শিশু নির্যাতন কি সভ্য যুগের সভ্য জাতির জন্য অসভ্যতার বহি:প্রকাশ নয়?
আমাদের মানবতাবোধ কতটা বিবর্জিত হলে, আমাদেরই চোখের সামনে পথ-ঘাট, শীত-গরম, বর্ষা-রোদ উপেক্ষা করে রাস্তায় দিনাতিপাত করে পথশিশুরা। তারা ভাবে আমাদের জন্মটাই বুঝি পাপ। অথচ তাদের এভাবে পথে ভাসমান জীবন কাটানোর জন্য আমরাই দায়ী। আমাদেরই কর্মের ব্যর্থতা, অপারগতা কিংবা কৃতকর্মের পাপের বোঝা তাদেরকে বহন করে আজ এ রাস্তায়, কাল অন্য রাস্তার ধারে আশ্রয় নিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে ছন্নছাড়া ছিন্নমূল জীবনযাপন করতে হচ্ছে। কেননা, সন্তান সম্ভাবনা মা তালাকপ্রাপ্ত হয়ে কিংবা স্বামীবঞ্চিত হয়ে রাস্তায় সন্তান প্রসব করে পালিয়ে যায়। কোন সময় অবৈধভাবে জন্ম নেওয়া শিশুটির শেষ আশ্রয় হয় এ পথ-ঘাট। এতিম-অসহায় হয়ে দরিদ্র পিতা-মাতার সঠিক দেখভাল না পেয়ে পরে আশ্রয় হয় তাদের রাস্তায়। আবার আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশিদের ওপর বর্তিত ধর্মীয় অনুশাসন না মানাও পথশিশুর সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য দায়ী।
এছাড়াও ক্ষুধা, দারিদ্র, নদীভাঙ্গন, শৈশবে বাবা-মায়ের হঠাৎ মৃত্যু ইত্যাদি নানা কারণে পথশিশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দায়ী এ দেশের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা যেখানে কেউ কারোর খবর রাখে না। উপরন্তু রাজনৈতিক হামলা, মারামারি, মিছিল, পিকেটিং, নেশার ব্যবসা করানো, চুরি, ছিনতাই, মাস্তানি, সন্ত্রাসী করানো, অবৈধ যৌনাচারে ব্যবহার করানোসহ নানাবিধ অপকর্ম তাদের দিয়ে করিয়ে আমরাই আজ নেতা, সমাজসেবক, জনহিতৈষী, জনপ্রতিনিধি, মন্ত্রী ইত্যাদি সেজে চোখে রঙিন চশমা লাগিয়ে উন্নয়নের শীর্ষে আরোহণের আমেজে ঘুরে বেড়াই। পথশিশুদের বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে ২০১৬ সালে সোশ্যাল এন্ড ইকোনমিক এনহ্যান্সমেন্ট প্রোগ্রাম (সিপ) নামে এক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার গবেষণায় দেখা যায়, পথশিশুদের প্রায় ৪৪ শতাংশ মাদকাসক্ত, ৪১ শতাংশ শিশু বিছানা ছাড়া ঘুমায়, প্রতিদিন গোসল করতে পারে না ৪০ ভাগ। খোলা জায়গায় মলত্যাগকারী শিশু ৩৫ ভাগ, ৫৪ শতাংশ অসুস্থ শিশুর দেখার কেউ নেই, ৭৫ শতাংশ শিশু চিকিৎসাবিহীন (ডাক্তারের যোগাযোগ করতে পারে না) থাকে।
দেশব্যাপী এত উন্নয়ন ও উন্নয়ন বাজেট থাকলেও এসবের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এসকল শিশু। কেননা এ সকল শিশুদের কল্যাণে নেই কোন বিশেষ নীতিমালা নামমাত্র ছাড়া। অথচ রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্বের অংশ বিশেষ সর্বস্তরের জনগণের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও লেখাপড়াসহ মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিত করা। তাহলে পথশিশুরা কি মূল জনগোষ্ঠী বা জনসাধারণের গণনার বা অংশের মধ্যে বিবেচিত হয় না, পরে না?
আবার অন্যদিকে পথশিশুদের পিতা-মাতার সঠিক পরিচয় ও ঠিকানা না থাকাতে তাদের জন্মনিবন্ধন করা যায় না বা করা হয় না। ফলে এসকল পথশিশু ভবিষ্যতে দেশের নাগরিক সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হয়। তাই এদের জন্য একটি সমন্বিত পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা প্রণয়ন ও যথার্থ বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা থাকা জরুরী। যাহোক, ১৯৭৪ সালের ২২ জুন বঙ্গবন্ধুর আমলে সর্বপ্রথম জাতীয় শিশু আইন (চিলড্রেন অ্যাক্ট) হয়। এতে কিয়দাংশ শিশু অধিকার রক্ষিত হয়। ২০১৪ সালের মার্চে ১০ টাকায় পথশিশু ও কর্মজীবী শিশুদের ব্যাংক হিসাব খোলার উদ্যোগ বাংলাদেশ ব্যাংক নিলেও, সে উদ্যোগের তেমন সাড়া মেলেনি।
(চলমান থাকবে)