বৃহত্তর ময়মনসিংহ

৩২৫

আশরাফুল সুমন,ময়মনসিংহঃ পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় অবস্থিত বাংলাদেশের অতি প্রাচীন একটি জেলার নাম ময়মনসিংহ ‘মুমেনশাহী’ পরগণাকে কেন্দ্র করে জেলাটি গঠিত হওয়ায় ইংরেজ আমলে (১৭৫৭ সাল থেকে ১৯৪৮) এর নাম মুমেনশাহী জেলা রাখা হয়। পরে পর্যায়ক্রমে ‘মাইমেনসিং’ এবং আরো পরে বর্তমানে এর নাম ময়মনসিংহ হয়। ১৯৬৯ সালের আগ পর্যন্ত উক্ত জেলাটি বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা হিসেবে পরিজ্ঞাত থাকে।

পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে প্রথম টাঙ্গাইল এবং ১৯৮৪ সালে কিশোরগঞ্জ পৃথকভাবে দু’টি জেলা গঠিত হয়। আরো পরে ক্রমাগত জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে এটি বর্তমানে আর বৃহত্তর জেলা নেই। তবে আমরা ময়মনসিংহ জেলাবাসী কিয়দাংশ হলেও পুনরায়, আমাদের পূর্বের মত একান্নবর্তী থাকার গৌরব লাভ করেছি। কেননা উক্ত জেলাটি ময়মনসিংহ বিভাগ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ইং মোতাবেক দেশের প্রশাসন সংক্রান্ত সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ National Implementation Committee for Administrative Reforms (NICAR) ৮ম বিভাগ হিসেবে অনুমোদন করে ময়মনসিংহকে।

৪টি জেলা যথাক্রমে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, জামালপুর ও শেরপুর নিয়ে ময়মনসিংহ বিভাগ। এর উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্য, দক্ষিণে ঢাকা বিভাগ, পূর্বে সিলেট বিভাগ এবং পশ্চিমে রংপুর ও রাজশাহী বিভাগ। আয়তন ১০,৬৬৯ বর্গ কি.মি। মোট জনসংখ্যা ১ কোটি ১৩ লক্ষ ৭০ হাজার। ভোটার সংখ্যা ৭৭ লক্ষ ১২ হাজার ৩৫৯ জন। মোট উপজেলার সংখ্যা ৩৫টি। থানা আছে ৩৭টি। পৌরসভার সংখ্যা ২৬টি। ইউনিয়ন- ৩৫২টি। গ্রাম আছে ৭,০৩০টি। উক্ত বিভাগে সংসদীয় আসন সংখ্যা ২৪টি (ময়মনসিংহ- ১১টি, জামালপুর- ৫টি, নেত্রকোনা- ৫টি, শেরপুর- ৩টি)

ময়মনসিংহ বিভাগের উল্লেখযোগ্য অর্জনসমূহ:

১। মান সম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে এবং ঝরে পড়া রোধকল্পে এ বিভাগের মোট ৪টি জেলার ৪,৮৪৯টি বিদ্যালয়ে ৭,৭২,৯৪৮টি টিফিন বক্স বিতরণ করা হয়েছে।

২। এ বিভাগের সকল উপজেলায় ভিক্ষুক জরিপ ও পুনর্বাসন তহবিল গঠন করা হয়েছে।

৩। সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ নিরসনে জেলা পর্যায়ে ৯টি, উপজেলা পর্যায়ে ১০৫টি, পৌরসভা পর্যায়ে ৭৫টি এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে ৭৬৫টি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

৪। ২০১৬ – ২০১৭ সালে ৬৬৪টি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা হয়েছে।

৫। ভূমি বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান লাভের জন্য জনগণের সুবিধার্থে সকল উপজেলা ভূমি অফিসের উদ্যোগে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গ্রোথ সেন্টার, ইউনিয়ন পরিষদের ভূমি শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। পাশাপাশি আরওআর, নামজারি ও বিবিধ মামলার নথিসমূহ যথাযথভাবে সংরক্ষণের জন্য সকল উপজেলা ভূমি অফিসের রেকর্ডরুম সংস্কার করা হয়েছে এবং সাল ভিত্তিক সজ্জিত করা হয়েছে।

৬। ১১তম শিক্ষা বোর্ড হিসেবে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ময়মনসিংহ গঠন করা হয়েছে।

৭। ময়মনসিংহ আঞ্চলিক স্কাউটস অফিস স্থাপন করা হয়েছে।

৮। ময়মনসিংহ বিভাগীয় শহরটি আধুনিক ও পরিকল্পিত শহর করার উদ্দেশ্যে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার ৪,৩৬৬.৮৮ একর ভূমিতে ব্রহ্মপুত্র নদের উপর ৩টি নান্দনিক সেতু দ্বারা নতুন শহরটি পুরাতন শহরের সঙ্গে সংযুক্ত করার মাধ্যমে, নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর একটি ভূমি ব্যবহারের মহাপরিকল্পনা প্রনয়ণ করেছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী নতুন শহরের রাস্তাগুলোর প্রশস্থতা হবে ১৫০ ফুট ও ১০০ ফুট। দাপ্তরিক, আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খেলাধুলা, বিনোদন ব্লকগুলো থাকবে আলাদা আলাদা। সুপরিসর একটি প্রাকৃতিক লেকের পাড়ে থাকবে আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টার, বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার, মিউজিয়াম, হোটেল-মোটেলসহ নান্দনিক অনেক স্থাপনা থাকবে।

এক নজরে ময়মনসিংহ জেলা প্রতিষ্ঠা:

১ মে ১৭৮৭ সাল, আয়তন: ৪,৩৯৪,৫৭ বর্গ কি. মি, পূর্ব নাম: নাসিরাবাদ। সীমানা উত্তরে: গারো পাহাড় ও ভারতের মেঘালয় রাজ্য, দক্ষিণে: গাজীপুর, পূর্বে: নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ এবং পশ্চিমে: শেরপুর, জামালপুর ও টাঙ্গাইল জেলা অবস্থিত। জনসংখ্যা: ৫৩,১৩,১৩৬ (পুরুষ- ২৯,১৫,৮৩৪ ও মহিলা- ২৩,৯৭,৩০২)। ভোটার সংখ্যা ৩৫ লক্ষ ৯৪ হাজার ৪৯৩ জন। জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটার ১,০২৯। এছাড়াও এ জেলায় গারো, কোচ, ডালু, বর্মণ, হাজং, প্রভৃতি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস আছে। ইউনিয়ন: ১৪৬টি, গ্রাম: ২৭০৯টি।

উপজেলা: ১। ময়মনসিংহ সদর, ত্রিশাল, গৌরীপুর, মুক্তাগাছা, ভালুকা, গফরগাঁও, ঈশ্বরগঞ্জ, নান্দাইল, ফুলবাড়িয়া, ফুলপুর, ধোবাউড়া, হালুয়াঘাট ও তারাকান্দা।
নদ-নদী: পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, বানার, শীতলক্ষ্যা। ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান: ত্রিশালের দরিরামপুরে কাজীর শিমলা, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গারো পাহাড়, গৌরীপুর ও মুক্তাগাছার রাজবাড়ি, আলেকজান্দ্রা ক্যাসেল, গসপেল চার্চ, বোকাইনগর দুর্গ, কেল্লা তাজপুর, শশীলজ, রাজ রাজেশ্বর ওয়াটার ওয়ার্কস, কালুশাহ দীঘি, চীনা মাটির টিলা, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালা, সার্কিট হাউজ, বিপিন পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেন, ব্রহ্মপুত্র নদ, অর্কিড বাগান, আলাদিনস পার্ক, সন্তোষপুর রাবার বাগান, স্বাধীনতা স্তম্ভ, ছালরা পিকনিক স্পট, আণবিক কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, মধুপুর জাতীয় উদ্যান, কাদীগড় জাতীয় উদ্যান, সাদু পানির মাছ গবেষণা ইনস্টিটিউট।

৭১‘র মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশের ১১টি সেক্টরের ১১ নং সেক্টরের এলাকা ছিল ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল। এ সেক্টরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডার ছিল মেজর এম আবু তাহের, স্কোয়াড্রন লিডার এম হামিদুল্লাহ। এ সেক্টরে যুদ্ধ করেন রংপুর কুড়িগ্রামের তারামন বিবি। আছেন জীবন্ত কিংবদন্তী বীর বিক্রম এম. হায়দার আলী (মধ্যহিস্যা, মুক্তাগাছা)। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের পর ফুলবাড়ীয়া উপজেলার ভবানীপুর ইউনিয়নের কন্দানিয়ানাঙ্গল শিমুল বাজারে মুক্তিবাহিনীর প্রথম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে উঠে এ অঞ্চলের। মূলত ২৭শে মার্চ ময়মনসিংহ সদর উপজেলার খাগডহর ইপিআর ক্যাম্পে বাঙ্গালি ও অবাঙ্গালি সৈন্যদের মধ্যে লড়াইয়ের মধ্যদিয়ে এ অঞ্চলের যুদ্ধ শুরু হয়। এছাড়াও পাকসেনারা এ জেলার বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে অসংখ্য নিরীহ মানুষকে নির্যাতন, গণহত্যা করে এবং অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায় গ্রামে গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন এ জেলার ৭টি বধ্যভূমি হলো। (ময়মনসিংহ সদরে ডাকবাংলোর চর, চকবাজার, জেলখানার চর, শম্ভুগঞ্জ নদীর তীর, বোরোর চর, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, মুক্তাগাছার রসুলপুর)।

নেত্রকোনার দূর্গাপুরের বাদামবাড়ি ভারতের সাথে সীমান্তবর্তী অঞ্চল। বাংলার প্রাচীন জনপদ হিসেবে খ্যাত ‘বঙ্গ’ জনপদের পূর্ব বঙ্গ ছিল ময়মনসিংহ। বাংলাদেশের বৃহত্তম ও সবচেয়ে উঁচু পাহাড় ময়মনসিংহে অবস্থিত গারো পাহাড়। আয়তনের দিক দিয়ে এ বিভাগ সবচেয়ে ছোট। ‘হোয়াইট ক্লে’ নামক সাদা রং এর এক ধরনের উষ্ণ মাটি ময়মনসিংহের বিজয়পুরে পাওয়া গেছে।

শিক্ষার হার: ৩৯.০১ ভাগ। দুটি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ৩টি, কলেজ ৬৩টি, ক্যাডেট কলেজ ১টি, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ৪টি, ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ২টি, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ১টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৫০৬টি, প্রাথমিক বিদ্যালয় ২,০৪৩টি, আর্ট স্কুল ১টি, কমিউনিটি বিদ্যালয় ৬টি, স্যাটেলাইট স্কুল ২৪টি, এনজিও পরিচালিত স্কুল ১,০৬৫টি, নার্সারি স্কুল ৫৯টি, মুক ও বধির বিদ্যালয় ১টি, সংগীত বিদ্যালয় ৩টি, মৌলিক শিক্ষা একাডেমী ১টি, মাদ্রাসা ১,২১২টি। এ জেলায় উল্লেখ করার মত পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকী দৈনিক: জাহান, বাংলার জমিন, ইনসাফ, আজকের স্মৃতি, শিপা, স্বদেশ সংবাদ, সাপ্তাহিক, ময়মনসিংহ বার্তা, আজকের মুক্তাগাছা। লোক সংস্কৃতি ময়মনসিংহ গীতিকার, ছড়া, বাউল সংগীত, পালাগীত, গারো সম্প্রদায়ের প্রবাদ, হাজং সম্প্রদায়ের শ্লোক (হিলুক), ধাঁধাঁ (থাচিকথা), গান (গাহেন) উল্লেখযোগ্য।

উৎপাদিত শস্য: ধান, পাট, ভুট্টা, তৈলবীজ, তুলা, রেশম, তামাক, আখ, পান ইত্যাদি শস্য উৎপাদনের জন্য ময়মনসিংহ অগ্রগণ্য।

যে কারণে এ জেলা বিখ্যাত: মুক্তাগাছার গোপাল পালের বিখ্যাত মিষ্টান্ন ‘মন্ডা’, জোড়া বাঘ মার্কা সরিষার তেল।

কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব:
১। হযরত মাও: শামছুল হুদা পাঁচবাগী (রহ) (১৮৯৯ – ১৯৮৭) বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন ও সমাজ সংস্কারক।
২। আবুল মনসুর আহমেদ (১৮৯৮ – ১৯৭৯) সাহিত্যিক, রাজনীতিক, সাংবাদিক, ও পাকিস্তানের মন্ত্রী।
৩। এ.কে.এম মোশাররফ হোসেন (১৯৩৪ – ২০২০) বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব, আমলা ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিমন্ত্রী।
৪। রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া (১৯২৬-১৯৯৪) প্রখ্যাত ভাষা সৈনিক ও রাজনীতিক।
৫। আব্দুল জব্বার ( ১৯১৯-১৯৫২) ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ।
৬। ডক্টর জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ( ১৯২০-১৯৭১) শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
৭। নলিনীরঞ্জন সরকার (১৮৮২ – ১৯৫৩) পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী, অস্থায়ী মুখ্যমন্ত্রী (১৯৪৮ ও ১৯৪৯), বাণিজ্য ও খাদ্যমন্ত্রী (১৯৪৩), শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ভূমি মন্ত্রী (১৯৪১), অর্থ মন্ত্রী (১৯৫৩)।
৮। মিতালী মুখার্জী- একজন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী।
৯। রাজা জগৎ কিশোর আচার্য চৌধুরী (১২৬৯ – ১৩৪৫ বাংলা) মুক্তাগাছার জমিদার। তাঁর দানশীলতা কিংবদন্তীতুল্য ১০। আবুল কালাম শামসুদ্দীন (১৮৯৭ – ১৯৭৮) সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও ভাষাবিদ।
১১। কলম আলী উকিল (১৯৩২-১৯৭৩) আইনজীবী, সমাজসেবী ও রাজনীতিক, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য।
১২। গোলাম সামদানী কোরায়শী (১৯২৯ – ১৯৯১) লেখক, শিক্ষাবিদ, প্রগতিশীল চিন্তার পুরোধা ব্যক্তিত্ব।
১৩। আব্দুল ওয়াহেদ বোকাইনগরী রাজনীতিক ও সুবক্তা।
১৪। মুজিবুর রহমান খান ফুলপুরী (১৮৮৯ – ১৯৬৯) সাংবাদিক, রাজনীতিক, সুবক্তা
১৫। মোস্তফা এম.এ.মতিন- আইনজীবী, রাজনীতিক, সমাজসেবী, ভাষা সৈনিক এবং প্রাদেশীক ও জাতীয় পরিষদের সদস্য।
১৬। মনোরঞ্জন ধর (১৯০৪ – ১৯৮৬) আইনজীবী, রাজনীতিক, কংগ্রেসের রাজনীতি করতেন, বঙ্গবন্ধু মন্ত্রীসভার আইনমন্ত্রী।

50% LikesVS
50% Dislikes
Leave A Reply

Your email address will not be published.