মোঃ রফিক ভূঁইয়া খোকা,বিভাগীয় প্রধান,ময়মনসিংহঃ ১১ শতকের সেলজুক তুর্কি জাতি ও প্রাচীন পারসিক জাতি পৃথিবীর দু‘টি গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতা আজারবাইজানের ইতিহাসের সাথে বিশেষভাবে জড়িত। আজারবাইজান (Azarbaycan) নামটি ফার্সি শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ অগ্নিভূমি। ধারণা করা হয়, দেশটির খনিজ সম্পদের সমৃদ্ধি ও অতি প্রাচীন জরথুষ্ট্রবাদের কেন্দ্রভূমি হওয়ার কারণেই দেশটির এরূপ নামকরণের কারণ। এটি এশিয়া মহাদেশের একটি প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র যা তাদের দেশিয় ভাষায় (Azarbaycan Respublikasi) বলা হয়। ইউরেশিয়ার দক্ষিণ ককেশাস (ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যবর্তী সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত একটি অঞ্চল,যা কৃষ্ণ সাগর এবং কাম্পিয়ান সাগরের মাঝে অবস্থিত (স্থলযোটক) অঞ্চলের অন্তর্গত একটি দেশ আজারবাইজান।
ইহা ছাড়াও ইউরাল পর্বতমালা, ইউরাল নদী, ককেশাস পর্বতমালা, বশফরাস প্রণালী, মর্মরা সাগর দারদানেলিশ প্রণালী এবং রাশিয়া, ইরান, তুরস্ক, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া আরো পাঁচটি দেশসহ ককেশাস অঞ্চল গঠিত। আয়তন ও জনসংখ্যার দিক দিয়ে এটি ককেশীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বৃহত্তম। দেশটির উত্তরে রাশিয়া, পূর্বে কাম্পিয়ান সাগর (হৃদ), দক্ষিণে ইরান, পশ্চিমে আর্মেনিয়া, উত্তর-পশ্চিমে জর্জিয়া। আজারবাইজানের রাষ্ট্রভাষা আজারবাইজানি। বাকু এ দেশের রাজধানীর নাম। এটি দেশের বৃহত্তম শহর যা কাম্পিয়ান সাগরতীরে অবস্থিত একটি বন্দর নগরি। ৮৬ হাজার বর্গ কিলোমিটার (৩৩,৪০০ বর্গমাইল) আয়তনের এ দেশটির লোকসংখ্যা ১ কোটি ১২ লক্ষ। ৯৭ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত দেশ আজারবাইজান। সপ্তম শতাব্দীতে এই দেশে মুসলমানদের করায়ত্ব হয়।
৬৪২ খ্রিস্টাব্দে আরব কর্তৃক দেশটির বিজয় ও স্থানীয়দের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার আগের তেমন কোন ইতিহাস আজারবাইজান সম্পর্কে পাওয়া যায় না। আরব সাম্রাজ্যের পতন হলে মঙ্গোল জাতি দেশটির ওপর ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালায়। তথাপি ১৩শ – ১৫শ শতকে মঙ্গোলীয় ইল খান, স্থানীয় শিরভান শাহ এবং পারস্যের সাফাভিদ রাজবংশের অধীনে দেশটি পুনরায় সমৃদ্ধি লাভের সুযোগ পায়। তবে ওসমানি খেলাফতের সময় আজারবাইজান তুরস্কের অধীনে চলে যায়। এক সময়ে বিশ্বের একক পরাশক্তি ওসমানী খেলাফত সাম্রাজ্যবাদী ফ্রান্স, রাশিয়া ও ব্রিটেনের যৌথশক্তির কাছে পরাজিত হলে আজারবাইজান দখল করে নেয় ব্রিটেন। পরবর্তীতে ১৮২৮ সালে চুক্তির মাধ্যমে এ অঞ্চলটি পারস্য ও রুশরা ভাগাভাগি করে নেয়। তারপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত দেশটিতে অভূতপূর্ব উন্নতির ছোঁয়া লাগে। ১৮শ ও ১৯শ শতকে ককেশীয় অঞ্চলের এ দেশটি পর্যায়ক্রমে রুশ ও পারস্যের শাসনাধীন থেকে যায়। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের গৃহযুদ্ধকালীন সময়ে ১৯১৮ সালের ২৮ মে আজারবাইজানের উত্তর অংশটি স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এতে একটি পৃথক ইসলামি প্রজাতন্ত্রিক রাষ্ট্রের সূত্রপাত করতে পারে আজারবাইজানরা। কিন্তু সে স্বাধীনতার স্থায়িত্ব ছিল মাত্র দুই বছর। রাশিয়ার বলশেভিক লাল সেনারা ১৯২০ সালে আক্রমণ করে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভূক্ত করে স্বাধীন আজারবাইজানকে। পুনরায় আন্ত: ককেশীয় সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের অংশ হিসেবে পরিচিত এ অঞ্চলটি ১৯৩৬ সালে ভেঙ্গে পৃথক তিনটি প্রজাতন্ত্র আজারবাইজান, জর্জিয়া ও আর্মেনিয়া গঠিত হয়। এই পৃৃথকীকরণের সময়ই নাগোর্নো-কারাবাখ আজারবাইজানের মূল ভূমির অংশ হলেও এলাকাটি খ্রিস্টান অধ্যুষিত হওয়ায় প্রতিবেশি রাষ্ট্র আর্মেনিয়াদের অবৈধ দখলদারিত্বের সমর্থন দিয়ে আসছে মুসলিম বিদ্বেষী রাশিয়াসহ বিশ্ব মোড়লরা।
তারপর ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেলে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র হয়। ১৯৯১ সালের ২০ অক্টোবর আজারবাইজান স্বাধীনতা ঘোষণা করে। স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই বিচ্ছিন্নতাবাদী আর্মেনিয়রা আজারবাইজানের সাথে সশস্ত্র সংঘাত অব্যাহত রাখে। ফলশ্রুতিতে দেশের স্বাধীনতা অস্থিতিশীল থেকে যায়। তবে ১৯৯৪ সালের মে মাসে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তির মধ্যদিয়ে এ বিধ্বংসী সংঘাতময় যুদ্ধের অবসান ঘটে। কিন্তু বিশ্বময় অধিকার বঞ্চিত ফিলিস্তিন, কাশ্মির, আরাকান ও অপরাপর মুসলিম অঞ্চল ও মুসলমানদের মত আজারবাইজানদের বৈধ ভূমি নাগোর্নো- কারাবাখসহ আরও ৭টি আজারবাইজানি জেলা এখনো আর্মিনিয়রা তাদের সামরিক নিয়ন্ত্রণে রেখেছে, আছে অমিমাংসীত। এ নিয়েই চলছে রক্ষক্ষয়ী যুদ্ধ-সংঘর্ষ প্রায় ৩০ বছর ধরে।
তেল, গ্যাস ও অন্যান্য মূল্যবান খনিজ সম্পদে ভরপুর এ দেশের খনিজ সম্পদ দিয়ে তৎকালীন সোভিয়েত তাদের পূর্বাঞ্চলের চাহিদা মিটাত। কেবল তাই নয়, এই ইউনিয়ন যদিও তাদের অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখত মুসলমানদের তেল দিয়ে তবুও এ দেশকে উন্নত করার জন্য তেমন কিছুই করেনি সোভিয়েত। বরং এ দেশের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোকে কীভাবে গরীব ও পশ্চাতপদ করে রাখা যায় সে চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল না এ ইউনিয়ন রাষ্ট্রের। মুসলমানদের তেল-গ্যাস ভাল লাগে, তখন তাদের কদরের শেষ নেই, সেসময় এক জোট থাকা যায়। কিন্তু মুসলমানদের অধিকারের ক্ষেত্রে তখন আর মুসলমান ভালো লাগেনা, স্বার্থ হাছিল হলেই পরে মুসলমান হয়ে যায় বিশ্ব সন্ত্রাসী বিচ্ছিন্নতাবাদী।
আজারবাইজানের ‘বাকু’ তেলক্ষেত্রগুলো বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অন্যতম তেলক্ষেত্র হওয়া সত্ত্বেও আজ দুর্নীতি, সংঘবদ্ধ অপরদিকে দুর্বল সরকার দ্বন্দ্ব, যুদ্ধ পরিস্থিতি কাঙ্খিত মুনাফা ও লক্ষ্যার্জন করা সম্ভব হচ্ছে না দেশটির পক্ষে। বরং হচ্ছে বাধাগ্রস্থ। যাহোক, সোভিয়েত ভেঙ্গে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে উন্নতির ছোঁয়া লাগে স্বাধীন আজারবাইজানের। বর্তমানে নিজ দেশের চাহিদা মিটানোর পরেও তেল রপ্তানি করে এ দেশটি। এমনকি তুরস্কের জ্বালানি চাহিদার একটি বিরাট অংশ আসে আজারবাইজান থেকে। আছে তুরস্কের ‘সাইহান’ বন্দরের মধ্য দিয়ে পাইপলাইন স্থাপন ইউরোপের দেশগুলোতে তেল রপ্তানির জন্য। এছাড়াও আজারবাইজানে ধান, গম, ভুট্টা প্রভৃতি খাদ্যশস্য এবং আঙ্গুরসহ বিভিন্ন ফলমূল প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয়।
মোটের ওপর এদেশের জনগণ যথেষ্ট সচ্ছলই বলা যায়। কিন্তু পৃথিবী যখন (আমারটা আমার, পরেরটাও আমার)- এ নীতিতে এসে দাঁড়ায় তখন কোন জনগোষ্ঠীর সচ্ছলতা ও সুখকর অবস্থানের স্বাভাবিকতা থাকে না, অজানা আশঙ্কা ও বিপদের বেড়াজালে পরিবেষ্টিত হয়, সুখ-শান্তি ক্রমশই বিলুপ্ত হয়। অপেক্ষাকৃত শক্তিশালীদের রোষানলে পরে। আজারবাইজানের চলমান যুদ্ধও বুঝি বর্তমান পৃথিবী নামক বসুন্ধরার সেরূপ বিরূপ পরিস্থিতির জানান দেয়।