লেখক,ফাহিম আল মামুনঃ একি কাতারে সব মাথারা পাশাপাশি দাড়িয়ে। বোঝা বড় দায় কে দোষী আর কে জ্ঞানী। ধিকি ধিকি বয়ে চলেছে আবহমান সময় গুলো। কিভাবে চিনবো সেই মাথাকে, যে কিনা মিথ্যের গুহা থেকে সত্য খুঁজে নিয়ে আসে।
সবাইকে নিজের মতো করে দেখতে চাওয়াটা মানুষের একটা পৈশাচিক ইচ্ছায় পরিনত হয়েছে। কোন এক টঙ্গে গিয়ে বসলেই দেশের সকল খবর পাওয়া যায় যার অনেকটাই ভুয়া খবরে ঢাকা। শুধু তাই নয়। এর পরে আবার আসে গুনিজনদের বিখ্যাত সেই কথা। দেশটা রসাতলে যাচ্ছে। কেয়ামত খুব কাছাকাছি চলে আসছে। কোন দেশ কি কি উন্নত করলো, কার শক্তি কতো বেশি এসব নিয়েই যত গুন্জন। আর শেষে একটা কথা থাকে তা হলো, এই দেশটার কিছু হচ্ছে না। কিন্তু মাথামোটা গুলো এটা নিয়ে মাথা ঘামায় না যে আমি নিজে কি করছি দেশের জন্য। অন্য দেশের সবকিছুই এতো পরিস্কার আর আমার দেশে এতো ময়লা আবর্জনা কেনো? ওদের দেশের মানুষের জিবনযাত্রা এতোটা উন্নত অথচ আমরা কেন এরকম? মাথামোটা গুলো এটা ভাবে না যে এর জন্য ওরাই দায়ী। বাইরের দেশে মানুষগুলো টিস্যু ব্যবহার করে ডাস্টবিনে ফেলে আর আমরা টিস্যু পেচিয়ে গোল করে ইচ্ছেমত ফুটবলের কিক মারি। পার্থক্যটা এখানেই।
‘বুঝলি স্বাধীন কিছু?’
স্বাধীন কোন তোয়াক্কা না করে বললো, “মাঝে মাঝে হয় কি আপনার? কি সব আউলা ঝাউলা কথা বলেন, সব মাথার উপর দিয়ে যায়। ওদিকে শিথি আপা ফোনের উপর ফোন দিতে আছে। ফোন রাইখা যে বাইরে গেছিলেন তো ফোনটা বন্ধ করে রাখা যাইতো না। বাজতে বাজতে কান ঝালাপালা কইরা দিছে।”
আমি স্বাধীনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলাম।
মোবাইলটা নিয়ে একটু ফেসবুকে এর ওর পোস্টে লাইক দিচ্ছি। স্বাধীনের দিকে তাকাতেই দেখি ও খুব মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করছে।
হঠাৎ মাথা উঠিয়ে ও বললো, “বড়আম্মায় আইসা একবার বোকাঝোকা করে গেছে আপনারে। একটু যেয়ে দেখা করে আসেন, আরেকটু ঝাড়িও খাইয়া আসেন।”
এসব কথায় পাত্তা না দিয়ে ওকে বললাম, ‘স্বাধীন, তোর শিথি আপাকে আমার সাথে কেমন লাগবে রে? ভাবছি শিথিকে তোর আপা থেকে ভাবী বানিয়ে দেই। কেমন হয় বলতো?’
একটু বিরক্তির ভাব নিয়ে ও বললো, “হুদাই স্বপ্ন না দেখে আগে বড়আম্মার কাছে যান নয়তো আপনার কপালে আজ ভাত নাও জুটতে পারে।”
আমি আবারও হাসলাম এটা শুনে।
“মোবাইলে বসে ফেসবুক চালানো যায় আর একটা ফোন করা যায় না। কতোবার ফোন করেছি দেখেছো?” শিথি আবার ফোন করলে রিসিভ করতেই উপরের কথাগুলো বললো।
‘ফোনে ব্যালেন্স ছিলো না তাই ফোন দিতে পারি নি।’
ওপাশ থেকে শিথি রেগে বললো, “তোকে যে কিপ্টা বলবো সেটাও পারি না আবার দায়িত্বহীন যে বলবো সেটাও পারিনা। কারন তুই শুধু আমার সাথেই এমনটা করিস। কেনো বলতো?”
আমি কিছু বললাম না। ও যখন রেগে যায় তখন তুই করেই বলে।
একটু চুপ থেকে ও বললো,”কি হলো কথা বলছো না কেনো?”
আমিও বুঝলাম রাগটা একটু করে কমতে শুরু করেছে। এই মেয়েটা আমার ওপর ঠিকমতো রেগেও থাকতে পারে না।
“তুমি কি চুপ করেই থাকবে? কতোবার ফোন দিয়েছি দেখেছো?”
‘একটু বাইরে বেরিয়েছিলাম। সীমা ফোন করে জরুরীভাবে দেখা করতে বললো তো, তাই আরকি।’
এবার একটু নরম গলায় ও বললো, “ওই মেয়ে ডাকলো আর তোমার যেতে হলো? কেনো ডেকেছিলো সে?”
আমি ওকে রাগানোর জন্য বললাম, ‘আরে এটা ওর আর আমার ব্যপার। তুমি শুনে কি করবে?’
“হুম তাই তো। আমি জেনে কি করবো। থাকো তুমি তোমার সীমা কে নিয়ে” বলেই ও ফোনটা রেখে দিল। আমিও মুচকি হেসে আবারও ফেসবুকে মনোযোগ দিলাম।
গতকাল রাতে অফিস থেকে যখন ফিরছিলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা সাতটা বাজে। বাসায় আসার জন্য রিকশা নিতেই সীমার সাথে কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়ে যায়। ওকে অনেক অস্থির দেখাচ্ছিল। আমাকে দেখতে পেয়েই ও দৌড়ে এসে বললো,
“মামুন কিছু না মনে করলে আমাকে একটু লিফ্ট দিতে পারবে? একটু জরুরী দরকার ছিলো?”
আমি কিছু না বলে একপাশে সরে বসলাম৷ ও তখন পাশে উঠে বসলো। রিকশাওয়ালা কে বললো, ইবনে সিনার হাসপাতালে যেতে। আমি কিছু বলছি না দেখে সেও কিছু বলছে না। একটু পরেই ও বললো,
“তোমাকে ধন্যবাদ। আর আমি সরি।”
‘সরি কেনো?’
“তুমি জানো কেনো আমি তোমাকে সরি বলেছি। আসলে ও সময় একটু বেশি উত্তেজিত ছিলাম আমি। আমার ওরকম করাটা উচিৎ হয়নি।”
‘তুমি কিসের কথা বলছো বুঝতে পারছি না।’
“তোমাকে চর মেরেছিলাম ওটার কথাই বলছি। তোমাকেও আর সবার মতো ভেবেছিলাম তাই না বুঝেই ওটা করেছি। তুমি ভুল বুঝোনা প্লিজ।”
‘আজ হঠাৎ তোমার কেনো মনে হলো যে ওরকমটা করা ঠিক হয়নি তোমার?’
“আজ নয়, আমি অনেকদিনেই বুঝেছি। শুধু বলতে পারিনি তোমায়। তাই আজ বলে দিলাম।”
‘যাক ওসব পুরনো কথা বাদ দাও। এতো তাড়াহুড়ো করে হাসপাতালে যাচ্ছো কেনো? কে আছে ওখানে?’
“রক্ত দিতে এক শিশু রোগী কে। ইবনে সিনাতেই ভর্তি আছে।”
‘ও আচ্ছা।’
আমি আর কথা বারালাম না। ইবনে সিনার কাছাকাছি আসতেই রিকশাওয়ালার ফোনে ফোন আসলো। কথা বলতে বলতেই হঠাৎ ও রিকশা থামিয়ে নেমে কথা বললো। লোকটাকে অনেক চিন্তিত আর অসহায় দেখালো। ফোন কেটে দিয়ে সে যেনো চিন্তার মহাসাগরে পরে গেছে। আমি রিকশা থেকে নেমে লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই কি কোন সমস্যা হয়েছে? আপনাকে বিমর্ষ লাগছে।’
লোকটি আমার হাতটা ধরে হাউমাউ করে কেঁদে বললো, “ভাই আমার বউটার পেটে বাচ্চা আছিলো ভাই। আট মাস চলে। ওর নাকি ব্যাথা উঠছে। ওর পাশে কেউ নাই ভাই। এখন আমি কি করুম ভাই কিছুই ভাইবা পাইতেছিনা।”
আমি লোকটিকে শান্ত করতে করতে বললাম, ‘ভাই আপনার বাড়ি কোথায়? কোথায় আছে আপনার স্ত্রী?’
“সাইন্স ল্যাবের পিছনে বস্তিতে আছে ভাই। ওয় ছাড়া আমার আর কেউ নাই ভাই।“
পেছন থেকে সীমা বললো, “মামুন তুমি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে উনার বাসায় গিয়ে উনার স্ত্রীকে নিয়ে আসো। আমি এখানেই আছি। শুধু উনার রিকশাটা একটু সাইডে রাখতে বলো। আমি দেখে রাখবো।”
আমি ইবনে সিনা থেকেই অ্যাম্বুলেন্সে করে রিকশাওয়ালার বাসায় পৌছে উনার স্ত্রীকে নিয়ে আসলাম। হাসপাতালে পৌছানোর আগেই উনার স্ত্রী জ্ঞান হারালো। সামনে হালকা পাতলা জ্যাম তো লেগেই আছে। এদিকে রিকশাওয়ালা কেঁদেই চলেছেন। তারপরও কোন রকমে হাসপাতালে নিয়ে এসে ভর্তি করালাম। ডাক্তার বিভিন্ন চেকআপ করে বললো,
“রোগীর শারিরীক অবস্থা ভালো না। নরমাল ডেলিভারি সম্ভবই না৷ তবে সিজার করতে হলেও একদিন দেখতে হবে আমাদের।”
সীমা বললো, “সমস্যা নেই আপনারা যেটা ভালো মনে হয় সেটাই করুন। আমরা রোগী আর বাচ্চা দুজনকেই সুস্থ চাই”
এদিকে আমি রিকশাওয়ালা ভাইকে সব বুঝিয়ে বললাম। তারপর তাকে বাইরে থেকে রাতের খাবার খাইয়ে আনলাম। সীমা আমাকে বললো,
“তুমি তাহলে এখন বাসায় যাও। আমার জন্য এসে অনেক কষ্ট করতে হলো তোমাকে।“
“এখানে কষ্টের কি আছে? আর তাছাড়া তুমি যা করছো তাতে আমি কিছুই নই। আমরা ছেলে হয়ে অনেক সময় রক্তের জন্য এতো ছোটাছুটি করি না অথচ তুমি মেয়ে হয়ে এসব করছো। তোমার থেকে শেখা উচিৎ আমাদের।”
“তুমি আমার ভুলটা একেবারেই ভেঙ্গে দিয়েছো মামুন। সত্যি তুমি অন্য সবার মতো নও। আমার একটা কথা রাখবে তুমি?”
‘হাহাহা, এভাবে বলছো কেনো? বলো কি বলবে?’
“আমাকে ক্ষমা করে দিয়ে তোমার বন্ধুত্বের হাতটা বাড়িয়ে দিবে আমার দিকে? আমি বন্ধু হিসেবে খারাপ নই কিন্তু।”
আমি হেসে হাতটা বাড়িয়ে দিলে দুজনে হ্যান্ডশেক করলাম। ও বললো, “আমার ওপর একটা তীব্র রাগ জমে আছে তোমার তাই না?”
‘ছিলো তবে এখন নেই। আর থেকেও কি লাভ বলো।’
“আমি এখনো অনেক গ্লানি নিয়ে থাকি জানো। তোমার সাথে সেদিনের দুর্ব্যবহারের জন্য। আমি তোমার সব খোঁজও রাখি। তুমিও কিন্তু অনেক মানুষকে সাহায্য করে থাকো এটাও আমি জানি। বলতে পারো এই কাজগুলো করে না নিজের ভেতরে একটা প্রশান্তি বিরাজ করে। তোমাকে বন্ধু হিসেবে পাওয়াও অনেক ভাগ্যের আমার কাছে।”
‘হাহাহা। তুমি একটু বারিয়ে বলছো৷ আচ্ছা তোমার খারাপ লাগছে না? রক্ত দিয়েছো কিছুক্ষন আগেই।’
“আগে লাগতো। এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। সত্যি বলতে রক্ত দিয়ে কেউ যখন সুস্থ হয় তখন তাদের চোখে যে ভালবাসা দেখি সেটা আর কোন কিছুতে পাওয়া যায় না। আচ্ছা এসব বাদ দাও। শিথির কি খবর বলো?”
‘তোমার মনে আছে শিথিকে? ও আছে, ভালোই আছে। শুধু আমার ওপর অনেক অভিমান নিয়ে আছে।’
“হাহাহা। মেয়েটা তোমাকে অনেক ভালবাসে জানো। তুমিও অনেক ভালবাস যদিও৷ তাই ওকে রাগাও কেনো বলতো?”
‘ওই যে কেউ আমার ওপর অভিমান করে আছে এটাই আমার ভালো লাগে। ধীরে ধীরে ওর সব অভিমান গুলো ভেঙ্গে দিয়ে নিজের করে নেবো। ততোদিনে একটু অপেক্ষা আর কি।’
“আচ্ছা অনেক কথা পরে আছে। গল্প হবে একদিন। অনেক রাত হয়েছে এবার বাড়ি যাও।”
‘মাথা খারাপ নাকি। রিকশাওয়ালা ভাইকে এভাবে রেখে কিভাবে যাই বলো?’
“এসব নিয়ে তোমাকে আর ভাবতে হবে না। সারাদিন অফিস করেছো আর এখন অনেক ধকল গেছে। তাই বাসায় গিয়ে রেস্ট নাও৷ আমি আছি এখানে। কাল এসে দেখে যেও না-হয়।”
‘তুমি সিওর তো? মানে তুমি এখানে থাকবে কোন সমস্যা হবে নাতো?’
“হাহা, না কোন সমস্যা হবে না তুমি যাও।”
‘আচ্ছা ঠিক আছে আমি কাল আসছি তাহলে।’
এরপর রিকশাওয়ালা ভাইকে শান্ত থাকতে বলে আমি ইবনে সিনা থেকে বাইরে বের হলাম। সীমা ভেতর থেকে হাত নারিয়ে বিদায় জানালো।
আসতে আসতে মনে পরলো ভার্সিটি জিবনের কথা। দ্বিতীয় বর্ষে সীমাকে প্রোপজ করেছিলাম আমি। একটা চর মেরে অনেক গালাগালি করেছিল সে। এতোটা খারাপ কিছু আসা করিনি। তার পছন্দ না হলে সে না বলে দিতো। এতোভাবে অপমান করার তো দরকার ছিল না। তাই ওর প্রতি একটা রাগ তো ছিলই। সেদিনের পর থেকে ওর সাথে কথা বলিনি আর। আর আজ তো কেন যেনো দেখা হয়েও গেলো। তবে ও ওর ভুলটা বুঝতে পেরেছে এটা ভেবেই ভালো লাগছে। এখন নিজেকে হালকা লাগছে অনেক। বাসায় এসে হালকা কিছু খেয়েই ঘুমিয়ে পরেছি। পরেরদিন সকালে অফিস যাওয়ার পথে হাসপাতালে ওদের জন্য কিছু খাবার নিয়ে দিয়ে আসি। পরে বিকেলের মধ্যেই অফিস থেকে বাসায় আসলাম। ইবনে সিনার দিকে যেতে হবে ভেবে তাড়াডাড়ি ফ্রেশ হতে গিয়ে পরে ফোনটা নিতেই ভুলে যাই। এদিকে দুদিন হলো শিথি রাগ করে কথাই বলছে না।
হাসপাতালে পৌঁছেই সীমাকে বাসায় যেতে বলি। ও কিছু না বলে চলে গেলো। আসল কথা হলো ওর নাম্বার টা নেওয়া হয়নি এখনো। ও চলে যাওয়ার পর ডাক্তার বললো,
“রোগীর অবস্থা একটু উন্নতির দিকে। আজ নয়তো কাল আমরা সিজার করতে চাচ্ছি।”
‘আপনাদের যেটা ভাল মনে হয় করুন। আমরা আছি।’
ডাক্তার চলে গেলে রিকশাওয়ালা ভাই আমার পাশ এসে হাতটা ধরে বললো, ভাই আপনেরা আমাগো জন্যে যা করতাছেন, নিজের কেউও এরকম করে কিনা জানি না ভাই। আল্লাহ আপনাগো ভালা করবো ভাই। বলেই কান্না করতে লাগলো। সীমা যাওয়ার সময় বলে গেছে উনাকে যে জব্বার ভাই থাকেন আসছি। ওই থেকে নামটা শুনে আমিও বললাম,
“দেখেন জব্বার ভাই, মানুষ মানুষের জন্য। আপনি এভাবে দেখছেন কেনো বিষয়টা। এর থেকে ভালো হয় আপনিও কোন মানুষকে বিপদে দেখলে সাহায্যের জন্য এগিয়ে যাবেন। টাকা পয়সা দিয়ে না পারলেও যেভাবে পারেন সাহায্য করবেন। এভাবেই আমরা পারি একটা ভাল সমাজ গড়ে তুলতে। তাই এসব নিয়ে কোন করুনা রাখবেন না। আজ আপনি না হয়ে যদি আমার ভাই হতো তাহলে কি এসব করতাম না আমি?”
এসব বলেই উনাকে শান্ত করে পাশে বসালাম। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এলো অথচ সীমা এখনো এলো না। এদিকে আমি ফোনটাও বাসায় রেখে এসেছি। একটু পরেই সীমা এসে আমায় দেখে হাসলো। বললো,“সরি তোমাকে অনেকক্ষন অপেক্ষা করালাম। আসলে বাসায় সব গুছিয়ে আসতেই একটু সময় লাগলো।”
‘আরে এটা কোন ব্যাপার নাহ। তুমি কি আজকেও থাকবে?’
“থাকতে হতে পারে। ডাক্তার পরে কিছু বলেছিল?”
‘হুম বলেছে যে আজ অথবা কালকের মধ্যেই তারা অপারেশন করে ফেলতে চায়।’
“ও আচ্ছা। তাহলে থাকতেই হয়। তুমি আজ বরং চলে যাও। কাল তো শুক্রবার। অফিস ছুটি। কাল বরং সকাল সকাল এসো।”
‘আচ্ছা। তোমরা রাতের খাওয়ার কোথায় খাবে? বাসা থেকে খাওয়ার নিয়ে আসি আমি?’
“সীমা হেসে বললো, আমি নিয়ে এসেছি। তুমি এসব নিয়ে ভেবো না।”
‘ঠিক আছে। আমি তাহলে আসি। কোন সমস্যা হলে ফোন দিও।’
“আচ্ছা দিবো”
আমি বাইরে বেরিয়ে আবার ভেতরে যেয়ে সীমাকে বললাম,
‘তুমি যে ফোন দেবে তো আমার নাম্বার আছে তোমার কাছে?’
ও খানিকটা হেসে নিয়ে বললো, “তোমার নাম্বার আছে আমার কাছে অনেক আগে থেকেই।”
মৃদু হেসে আমিও কিছু না বলে বাসায় ফিরলাম। আর এসেই তো দেখি শিথির অনেক ফোন সাথে স্বাধীনের মহামুল্যবান কিছু কথা। শিথি তো আবারও রাগ করে ফোন রেখে দিয়েছে আর এখন আমি ফেসবুকে ফুটফাট লাইক দিতে দিতে এসব ভাবছি। ঠিক তখনি অপরিচিত এক নাম্বার থেকে ফোন আসলো। রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে বললো,
“হ্যালো মামুন, আমি সীমা বলছি। তুমি কি জলদি একটু হাসপাতালে আসতে পারবে?”
‘আমি এখুনি আসছি। কোন সমস্যা হয়েছে কি?’
“ঠিক সমস্যা না। আবার সমস্যাও। তুমি জলদি একটু আসো।”
আচ্ছা ঠিক আছে বলেই শার্টটা হাতে নিলাম পরার জন্য। স্বাধীনকে বললাম,
‘যাবি আমার সাথে?’
“কোথায় যাইবেন?”
‘হাসপাতালে’
হাসপাতালের কথা শুনে আর কিছু জিজ্ঞেস না করেই ও বললো, চলেন।
স্বাধীনকে নিয়ে ইবনে সিনায় পৌঁছতেই সীমা আমার কাছে এসে বললো,
“রোগীকে এখুনি অপারেশন করাতে হবে। পঞ্চাশ হাজার টাকা এখুনি একাউন্টে দিতে হবে। কিন্তু এই মুহুর্তে এতো টাকা কোথায় পাবো? কিভাবে কি করবো বুঝতে পারছি না।”
নিজেও একটু টেনশনে পরে গেলাম। তারপরও ওকে বললাম,
‘তুমি এসব নিয়ে ভেবো না। আমি দেখছি কিছু করা যায় কি না। তুমি অপারেশন করে ফেলতে বলো।’
ওকে এটা বলে নিজে কি করবো ভেবে পাচ্ছি না। কার্ডে এখন এতো টাকাও নেই। ব্যাংক ও এখন খোলা পাবো না। কি যে করি। এসব ভাবতেই মনে হলো শিথিকে কি একবার জানাবো ব্যাপারটা। জানানো কি ঠিক হবে? এসব ভাবতে ভাবতেই ফোনটা দিয়েই দিলাম। ঢোকা মাত্রই ফোনটা রিসিভ হলো। মনে হলো ফোনের জন্যই অপেক্ষা করছিলো। কঠিন গলায় বললো,
“কি হলো, ফোন দিয়েছো কেনো?”
‘তুমি কি রেগে আছো?’
“আমি যে কোন মানুষের উপর রাগ করি না। কি দরকারে ফোন দিয়েছো সেটাই বলো?”
‘আসলে তোমার কাছে কি হাজার পঞ্চাশেক টাকা হবে। খুবি জরুরী ছিলো। নাহলে এভাবে তোমায় বিরক্ত করতাম না।’
“বিরক্ত না? তোমার ফোনে আমি বিরক্ত হই? সারাটাদিন শুধু তোমার একটা ফোনের অপেক্ষায় থাকি। আর তুমি বলো আমি বিরক্ত হই? তুমি বোঝনা কতটা ভালবাসি তোমায়? রাগ করেছি তখন, একটাবার ফোন দিয়ে কি ভালভাবে দুটো কথা বলা যায় না? কষ্ট দিতে খুব ভালো লাগে তোমায় তাই না?” বলতেই কান্না করা শুরু।
‘আমি সরি। আমি খুবি সরি। তুমি তো আমাকে বোঝই। আমি কি তোমাকে কম ভালবাসি? তবে আমাদের এসব অভিমানের শেষ পরে হবে। তুমি কি পারবে টাকাটা ম্যানেজ করে ইবনে সিনায় আসতে।’
“ইবনে সিনায় মানে। তুমি ওখানে কি করছো? এই তোমার কিছু হয় নি তো? সত্যি করে বলো কি হয়েছে? তুমি ঠিক আছো তো?”
‘আরে আমি ঠিক আছি। তুমি যদি পারো টাকাটা নিয়ে একটু জলদি আসবে? খুবি দরকার ছিলো।’
“তুমি থাকো আমি এখুনি আসছি। কোন চিন্তা করো না।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। সাবধানে এসো।”
ডাক্তারকে অপারেশনের ব্যবস্থা করে ফেলতে বললাম। সীমা বললো,
“শিথিকে ফোন করেছিলে তাই না?”
‘হুম, ও আসছে। আসলে এখন এতো ক্যাশ টাকা আমার কাছে নেই। তাছাড়া ব্যাংকও বন্ধ। তাই কোন উপায় ছিলো না।’
“ভালোই হয়েছে। ও আসুক দুটো গল্প করা যাবে।”
আমি হেসে পাশে গিয়ে বসলাম।
একটু পরেই শিথিকে দেখলাম ফোন দিতে দিতে ইবনে সিনায় ঢুকছে। আমাকে দেখতে পেয়েই ও দৌড়ে সামনে আসলো। ওকে কিছুটা খুলে বললাম। ও একাউন্টে গিয়ে কি যেনো কথা বললো ওদের ফোনে। একটু পরেই একজন ডাক্তার চলে আসলো। একাউন্টের সামনে গিয়ে উনি শিথিকে জড়িয়ে ধরলেন। শিথিও চাচ্চু বলে অনেক কথা বললো। একটু পরে শিথি হয়তো সবকিছু খুলে বললো। তখন ওই ডাক্তার একাউন্টে কি যেনো বললো, তখন একাউন্ট থেকে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলো। আমি আর সীমা ওদের দিকেই তাকিয়ে আছি। আরও দু একটা কথা বলে ডাক্তার চলে গেলো। শিথির চাচ্চু হবে সম্ভবত লোকটি। শিথি সামনে এসে বললো,
“এই তো রিসিভ পেয়ে গেছি। অপারেশন কিছুক্ষনের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে। আর কোন চিন্তা নেই।”
জব্বার ভাইকে দেখলাম আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। শিথি এতোক্ষনে সীমার দিকে তাকিয়েছে। এরি মধ্যে সীমা শিথির হাত ধরে একটু সাইডে নিয়ে গেলো। আমি কিছু বললাম না। এই মেয়ে যে একে কি বলবে জানি না। তবে কথা বলার সময় লক্ষ্য করলাম শিথি কয়েকবার আমার দিকে তাকালো। তারপর হঠাৎ ওদের মাঝে অনেকটা সখ্যতা দেখলাম। দুজনি হাসাহাসি করে কথা বলছে। স্বাধীনকে দেখলাম রিকশাওয়ালা ভাইয়ের পাশে বসে আছে। সেও এতোক্ষনে সব কিছু বুঝেছে। ওর বাম হাতে আমার ফোনটা দেখছি। আসার সময় মাকে বলে আসাও হয় নি। তাই ওকে বললাম, ফোনটা দেতো বাসায় জানিয়ে দেই। ও বললো, আমি জানায় দিছি, বড়আম্মায় ফোন দিছিলো।
একটু পরে শিথি আমার পাশে এসে বসলো। বললো,
“তুমি আমাকে বললেই পারতে যে দুদিন তুমি এখানেই ব্যস্ত ছিলে। আমি কি বুঝতাম না তোমাকে?”
‘তোমাকে এসব ঝামেলায় জড়াতে চাই নি তাই বলিনি। কিন্তু কি করবো জড়াতেই হলো।’
শিথি কিছু না বলে আমার কাধে মাথা রেখে হাত জড়িয়ে ধরলো। বললো,
“তোমাকে আমি হারাতে চাই না। অনেক কষ্ট দিয়েছো। আরও দেবে। শুধু হারিয়ে যেও না। আমি শুন্য তোমাকে ছাড়া।”
অপারেশন থিয়েটার থেকে ডাক্তার বের হতেই বললো,
“রোগীর ছেলে হয়েছে। তবে রোগীর কন্ডিশন একটু খারাপ। দোয়া করুন আপনারা।”
এটা শুনে জব্বার ভাই কাঁদতে শুরু করলেন। আমার হাত ধরে বললেন,
ভাই আমার বউটারে বাঁচাইতে কোন ভাই। ওয় ছাড়া আমার কেউ নাই। আমি ওর হাত ধরে ওকে শান্তনা দিচ্ছি। স্বাধীন পেছন থেকে ওনাকে থামানোর চেষ্টা করছে। একটু শান্ত হতেই ডাক্তার বের হয়ে বললো,
“আল্লাহর রহমতে মা ছেলে দুজনি সুস্থ আছে। একটু পরেই বেড এ দেওয়া হবে। মিস্টি খাওয়াতে ভুলবেন না যেনো।”
এ কথা শোনার পর শিথি সীমাকে জড়িয়ে কেঁদেই ফেললো। জব্বার ভাইর চোখেও স্বস্তির ছাপ দেখা যাচ্ছে। সব ফরমালিটিস পুরন করে রিসিপশনের সামনে এসে দাড়ালাম। জব্বার ভাই হুট করে জড়িয়ে ধরে কাঁদলো। শান্তনা দিতে দিতে হয়রান আমি। মজা করে বললাম,
‘মিস্টি তো খাওয়াবেন তাই না? আর ছেলের নাম কি রাখবেন ঠিক করেছেন কি?’
পকেট থেকে কিছু গয়না বের করে বললো,
“ভাই আমার কাছে এতো টাকা পয়সা নাই। এইটা রাখেন। আপনাগো অনেক খরচ হইছে। এইগুলো দিয়া যদি কিছুটা পুরন হয়।”
পেছন থেকে সীমা বললো,
“জব্বার ভাই এসব লাগবেনা আমাদের। যদি পারেন বিপদগ্রস্ত মানুষ পেলে একটু সাহায্য করিয়েন। এতেই হবে। পারলে নিজের সন্তানকে ভালমন্দ খাওয়াবেন। আর হ্যা মনে রাখবেন, মানুষ মানুষের জন্য।”
“জি আপামনি মনে রাখবো। তয় একটা অনুরোধ করতাছি। আমার ছেলের নামটা আপনারাই দিবেন। এতোটুকু কইরেন আমার জন্য।”
সবাই মুচকি হেসে বললাম, ঠিক আছে।
জব্বার ভাইকে আজ হাসপাতালেই থাকতে বললাম। আর আমরা কাল এসে রিলিজ নিয়ে নিবো। শিথিকে বললাম,
‘তুমি স্বাধীনের সাথে গল্প করো, আমি সীমাকে রিক্সায় উঠিয়ে দিয়ে আসছি।‘
‘ও হাসিমুখে বললো, রাত হয়েছে। ওকে বাসায় দিয়ে এসো।’
আমি হাসলাম। এদিকে স্বাধীনকে শিথি ডেকে নিলো। সীমাকে নিয়ে রিক্সায় যাচ্ছি। ও বললো,
“শিথির মতো মেয়ে আজকাল হয় না বুঝেছো। ওকে আগলে রেখো। আর জব্বার ভাইর ছেলের নাম আমি মামুন রাখবো ভেবেছি।”
‘হাহাহা৷ একটু বেশি সিনেমার মতো হয়ে যাচ্ছে না? আমি তো তেমন কিছুই করিনি। যা করেছো তার মুলে তুমিই আছো। কিন্তু মেয়ের নাম তো একটা ছেলেকে দেওয়া যায় না তাই ভাবছি ওর নাম রাখবো, সীমান্ত। সীমান্ত আল মামুন। যার মানে হলো শেষ প্রান্ত। আর এটাতে তুমি আমি দুজনি আছি।’
“হাহাহা। ভালো বলেছো। তাই হোক তবে। আর হ্যা তোমাকে একটা কথা বলা হয় নি। সামনে মাসের ২৬ তারিখে আমার বিয়ে। তোমরা সবাই আসবে কিন্তু।”
‘সত্যিই। অবশ্যই আসবো। বিয়ের বিরিয়ানি কি আর মিস করা যায় বলো?’
“হাহাহা। আসবে। সামনে আমার বাসা এসে গেছি। ভালভাবে যেও আর কাল ইনশাআল্লাহ দেখা হচ্ছে।”
‘হুম অবশ্যই।’ বাসায় ঢোকার আগে ও বললো, “আই ফ্রেন্ড ইউ মামুন”
মুচকি হেসে আমিও বললাম, ‘আই ফ্রেন্ড ইউ ঠু।’
ওকে পৌছে দিয়ে আমি আবারও ইবনে সিনায় আসলাম। শিথি আর স্বাধীনকে নিয়ে বের হলাম। শিথি আমার হাত ধরে হাঁটছে। কেউই কোন কথা বলছে না। স্বাধীন অনেকটা সামনে এগিয়ে গেছে। শিথি ওর বাসার কাছে আসতেই অনেকটা করুন চোখে তাকালো ও। বললো,
“আমাকে কষ্ট দিও না কেমন। আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি। প্রতিদিন অন্তত একবার ফোন করো। আমার ভাল লাগবে। আর প্লিজ ফোনটা সাথে রেখো। আমি ফোন করলে ধরো।”
আমি মৃদু হেসে বললাম, ঠিক আছে। তুমি বাসায় যেয়ে ঘুমিয়ে পরবে ঠিক আছে?
আচ্ছা ঠিক আছে। তারপর ও কপালে একটা চুমু দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। কিছুক্ষন জড়িয়ে ধরে ছেড়ে দিয়ে বললো,
“বাসায় গিয়ে ফোন দিবে। তুমি ফোন না দিলে আমি ঘুমাবোনা কিন্তু।”
‘হাহাহা আচ্ছা ঠিক আছে।’
“ফিরে যেতে যেতে ও বললো, আমি জানি তুমি আমার কথা শুনবে না। তাই এবার এর ব্যবস্থাও করেছি। বাসার গেটের কাছে গিয়ে আবারও বললো, সীমার সাথে বেশি কথা বলা যাবে না কিন্তু।”
আমি হাসলাম এটা শুনে। শিথিও মুচকি হেসে ভেতরে চলে গেলো। ওর এই ছোট্ট হাসিটা আমার অনেক ভালো লাগে। বলা যায় বারবার ওর প্রেমে পরার এটাও একটা কারন।
স্বাধীন আর আমি রাস্তায় হাঁটছি। বললাম,
‘কিরে তোর ক্ষিদে পায় নি?’
“না পায় নি। আপনার পাইছে?”
‘না পায় নি। চল চা খেয়ে আসি রইসের দোকান থেকে।’
“হুম চলেন। শিথি আপায় আইজ একটা ফোন আর একশ টাকা দিছে। সুন্দর দুকাপ চা হইয়া যাইবো।”
‘আর যদি তোর আপা ফোন করে তখন কি বলবি?’
“কমু যে ভাইয়ে এখন চা খাইতাছে। আর তাছাড়া শিথি আপায় আইজ থেকে ভাবি বলে ডাকতে কইছিলো। আমি না করছি। কইছি, বিয়া হইলেও আপনারে আপাই ডাকুম। এই ডাকটাই ভালো লাগে।”
‘হাহাহা। তাই নাকি। আচ্ছা চল তাহলে তোর আপার টাকায় চা খেয়ে আসি।’
এমন সময় স্বাধীনের ফোনে শিথি ফোন করেছে। রিসিভ করে ও লাউড স্পিকার দিলো। শিথি বললো,
“কিরে তোরা কোথায় এখন?”
স্বাধীন বললো, “আমরা হাঁটতাছি রইসের দোকানে চা খামু বলে।”
“একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও বললো, এতো বুঝানোর পরেও কিছু হলো না। তোর ভাইরে বলবি, হিমু না হয়ে বাসায় গিয়ে রেস্ট নিতে।”
“আপা আপনে চিন্তা কইরেন না। চা খাইয়া বাসায় যাইয়া ভাইরে ঘুমাইতে কমু।”
“তুই শুদ্ধ ভাষা আর কতোদিনে শিখবি? ভালোভাবে কথা বলতে পারিস না?”
“আমার হয় না আপা। যেদিন হইবো সেদিন কমু।”
দুটোয় গেছে বলেই ফোনটা কেটে দিলো শিথি। স্বাধীনের দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘তোর আপায় রাগ করছে নারে স্বাধীন?’
“হ ভাই, সেই রাগ করছে। কি করা যায় কোন তো?”
‘সব ঠিক হয়ে যাবে রে। কালকের নতুন সূর্যটা সব ঠিক করে দিবে। ও আমার ওপর রেগে থাকতে পারে না।’
“হু ভাই, ঠিক কইছেন। তয় উনারে ভাবি বানাইলে মন্দ হয় না কিন্তু”
আমি হাসলাম। তাকিয়ে দেখি স্বাধীনও হাসছে। খোলা রাস্তায় প্রতিফলিত হচ্ছে দুটো মানুষের হাসির প্রতিধ্বনি। সাথে স্বস্তির এক দীর্ঘশ্বাস আর কিছু করুন চোখে প্রশান্তির দৃষ্টিগোচর…. ……